সন্ত্রাস আজ আর কোন দেশ, জাতি বা ভ‚-খন্ডের সমস্যা নয়। এটি আজ একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা।

ড. মুহাম্মদ আবু ইউসুফ

সন্ত্রাস আজ আর কোন দেশ, জাতি বা ভ‚-খন্ডের সমস্যা নয়। এটি আজ একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। ‘সন্ত্রাস’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘অতিশয় ত্রাস, ভয়ের পরিবেশ’। আর সন্ত্রাসবাদ হল রাজনৈতিক বা গোষ্ঠীগত ÿমতা লাভের জন্য অত্যাচার, খুন, মারামারি, হিংসাত্মক ও ত্রাসজনিত বেআইনি কর্মপন্থা অবলম্বন। ১৯৯৮ সালে এপ্রিল মাসে আরব রাষ্ট্রগুলোর স্বরাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রীদের সম্মেলনে সন্ত্রাসের সংজ্ঞা এরূপ নির্ধারণ করা হয়, ‘সন্ত্রাস হল ব্যক্তিক বা সামষ্টিক অপরাধ মনোবৃত্তি হতে সংঘটিত নিষ্ঠুর কাজ বা কাজের হুমকি, যে প্ররোচনা বা লÿ্যইে তা হোক না কেন, যা দ্বারা মানুষের মাঝে ভয়ভীতি সঞ্চার করা হয় বা তাদেরকে কষ্টে ফেলার হুমকি দেয়া হয় বা তাদের জীবন, স্বাধীনতা নিরাপত্তাকে ধ্বংসের মুখে ফেলা হয় বা পরিবেশকে ÿতির মুখোমুখি করা হয় অথবা সাধারণ জনগণের বা সরকারি সম্পত্তি ছিনতাই করা, জবর দখল করা বা নষ্ট করা হয় অথবা কোন রাষ্ট্রীয় উৎসকে ধ্বংসের মুখে ফেলা হয়।’

সন্ত্রাস একটি ব্যাপক বিধ্বংসী মরণব্যাধি যা আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মারাত্মক রূপ পরিগ্রহ করেছে। আমাদের প্রিয় মাতৃভ‚মিও আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের শিকার। এর হাত থেকে বাঁচার জন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। ‘ওয়ার্ল্ড পিস ইন্ডেক্স’ এর সমীÿানুযায়ী বাংলাদেশ শান্তিতে পৃথিবীর অনেক বৃহৎ ও নামকরা রাষ্ট্র ও দেশের চেয়েও অনেক ভাল অবস্থানে আছে। এ অবস্থা থেকে দেশকে উদ্ধার করার জন্য সব ধর্মের ধর্মীয় নেতাদের অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করতে হবে। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট ৬৩টি জেলায় একযোগে বোমা হামলার পর এ দেশের ৫ লাখ মসজিদের ইমামগণ সে সময় ঐতিহাসিক ভ‚মিকা পালন করে প্রমাণ করেছিলেন ধর্মীয় নেতাগণ এমন ভ‚মিকা পালন করতে পারেন যা অনেকের পÿেই সম্ভব নয়।

আজকে কথায় কথায় সন্ত্রাসকে ধর্মের সাথে জড়িত করার একটি প্রবণতা লÿ্য করা যায়। আসলে ধর্ম ও সত্যিকার ধার্মিকেরা কখনো সন্ত্রাসকে আশ্রয় বা প্রশ্রয় দেননি এবং দিতে পারেন না। বরং পৃথিবীতে অতীতে সকল ধর্মই সন্ত্রাসের প্রতিরোধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজ করছে। আমরা জানি পৃথিবীর আদিকাল থেকে ধর্ম মানুষ ও মানব সমাজের একান্ত সহযাত্রী হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকে অদ্যবধি অধিকাংশ মানুষ প্রত্যÿ বা পরোÿভাবে ধর্মের সাথে জড়িত বিধায় ধর্ম ও সমাজের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।

মানব জাতির কয়েকশত বছরের ইতিহাস পাঠে জানা যায়, বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে ধর্ম তাদের আদর্শ হিসেবে কাজ করেছে এবং ধর্মকে কেন্দ্র করে এক একটি সভ্যতা মানবজাতিকে জ্ঞানে সুখে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। চীন দেশীয়, মিশরীয়, পারস্য, বেবিলনীয়, ভারতীয়, রোমান ও গ্রিক প্রতিটি সভ্যতা ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে। তবে কখনো কখনো ধর্মের অনুসরণকারীরা বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তি ও সংকীর্ণ গোষ্ঠী স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করেছে। ধর্মাবলম্বীগণ সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদেরকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা না করে গোঁড়ামির আশ্রয় নিয়ে ধর্মকে গণস্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে ÿেত্রবিশেষে ধর্মের গতিশীলতাকে অস্বীকার করে ধর্মের সুনাম নষ্ট করেছে। তথাপি সভ্যতা বিনির্মাণে ধর্মের ভ‚মিকা অনস্বীকার্য।

পৃথিবীর বুকে সংঘটিত যুদ্ধ বিগ্রহের প্রায় সবক’টিই সংঘটিত হয়েছে ÿমতার দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে। অতীত এবং বর্তমানকালে সংঘটিত যুদ্ধ বিগ্রহের সবÿেত্রেই মূল কারণ ছিল রাজ্য দখল অথবা অর্থনৈতিক ও সামরিক। আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে কালো অধ্যায় হিসেবে খ্যাত দুটি বিশ্বযুদ্ধের কোনটিই ধর্মকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়নি। এমনকি হিটলার শাসিত জার্মানিতে ইহুদি নিধনের পেছনে মূল কারণ ধর্মীয় ছিল না বরং সেটি ছিল অর্থনৈতিক বা অন্য কিছু।

মানুষের নাগরিক অধিকারের প্রাথমিক বিষয় হলো তার বেঁচে থাকার অধিকার। আর অপরকে বাঁচতে দেয়া হলো নাগরিক কর্তব্যের মধ্যে অন্যতম। এটিই ইসলামের প্রাথমিক কথা। মানুষের জানমালের নিরাপত্তাই যদি না থাকে তবে তারা এ পৃথিবীতে কী ভাবে একত্রে বসবাস করবে? ইসলাম অন্যায়ভাবে মানব সন্তানকে হত্যা করা কঠোর ভাষায় নিষিদ্ধ করেছে। পবিত্র কুরআনের সূরায়ে মায়েদায় মহান আলøাহ বলেন, “এ কারণে আমি বনি ইসরাইলকে লিখে দিয়েছিলাম যে, যে ব্যক্তি বিনা অপরাধে কিংবা ভ‚-পৃষ্ঠে কোন গোলযোগ সৃষ্টি করা ছাড়াই কাউকে হত্যা করল, সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কোন একটি মানুষের প্রাণ রÿা করল সে যেন সমগ্র মানবজাতিকে রÿা করল।” পবিত্র কুরআনের এ আয়াতে মানব সন্তানকে হত্যা কত বড় অপরাধ তা স্পষ্ট ভাষায় বুঝানো হয়েছে। একজন ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা সমগ্র মানবজাতিকে হত্যার নামান্তর বলে উলেøখিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে, “ফিতনা বা বিপর্যয় সৃষ্টি করা হত্যার চেয়েও জঘন্য।”

এ প্রসঙ্গে আলøাহর রাসুল সা: বলেছেন, “মুসলমান হল ঐ ব্যক্তি যার হাত ও মুখ থেকে অপর মুসলমান নিরাপদ।” অর্থাৎ হাত ও মুখের অনিষ্টের কথা বুঝানো হয়েছে। পবিত্র কুরআনের অসংখ্য সুস্পষ্ট বক্তব্য থেকে বুঝা যায়-ইসলামে সন্ত্রাস, হত্যা বা বিপর্যয়ের কোন স্থান নেই। কোন মুসলমানের পÿে এ ধরনের কাজ করা সম্ভব নয়।

আজকের পৃথিবীতে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ নাগরিক সমাজ বা সিভিল সোসাইটির অন্যতম প্রভাবশালী অংশ হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছেন। সবধর্মের অনুসারীদের নিকট ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ পরম শ্রদ্ধা ও আস্থার প্রতীক। হতাশাগ্র¯Í ও দিশেহারা মানুষ তাদের দিশা বা পথ নির্দেশনার জন্য ধর্মীয় নেতাদের দ্বারস্থ হয়ে থাকেন। ধর্মীয় গুরুরা যেহেতু ইহলৌকিক জীবনের চেয়ে নিজেরা পারলৌকিক জীবনকে বেশিমাত্রায় অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন সে কারণে তারা তাদের অনুসারীদের নিকট আস্থার কেন্দ্রবিন্দু। আজকের পৃথিবীতে উন্নয়নের এজেন্টগণ যেহেতু ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে বেশি পরিমাণ সাফল্য অর্জন করতে সÿম হয়েছেন সেহেতু সন্ত্রাস নিরসনেও তারা কার্যকরী ভ‚মিকা পালন করতে পারবেন বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস কর যায়।

সন্ত্রাস নিরসনে ধর্মীয় নেতাগণ যে সকল ভ‚মিকা পালন করতে পারেন :

১. ধর্মীয় নেতাগণ ধর্মের প্রকৃত শিÿা স্বীয় ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে তুলে ধরতে যথাযোগ্য ভ‚মিকা পালন করতে পারেন। ২. পরধর্মের তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে সহনশীল পরিবেশ তৈরি করতে বিশেষ ভ‚মিকা রাখতে পারেন। ৩. পরধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান আহরণে স্ব-স্ব ধর্মের লোকদের উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। ৪. নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার শিÿা বি¯Íার করতে পারেন। ৫. সন্ত্রাসে জড়িতদেরকে ভালবাসার মন নিয়ে মোটিভেশন ও পরিশুদ্ধ করতে পারেন। ৬. সকল মানুষ আদমের সন্তান এ হিসেবে তারা পরস্পর ভাই ভাই ও মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই এ দীÿায় সবাইকে উজ্জীবিত করতে পারেন। ৭. আন্তঃধর্মীয় সংলাপ জোরদার ও ব্যাপক করার ব্যবস্থা করতে পারেন। ৮. সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মোটিভেশনমূলক প্রচারণায় সকল ধর্মের উপাসনালয়, ধর্মীয় উৎসব ও সভা সমাবেশকে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। ৯. ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ সন্ত্রাস বিরোধী প্রচারণায় গণমাধ্যমকে কাজে লাগাতে পারেন। ১০. সন্ত্রাসবাদকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং এমন পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে যাতে কেউ এ পথে পা বাড়াতে সাহস না পায়। ১১. সন্ত্রাসের ÿতিকর দিকসমূহ বিশেষকরে এর সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও আইনগত দিক সম্পর্কে জণগণকে সচেতন করে গড়ে তোলা। ১২. সন্ত্রাসের উৎসস্থলসমূহ চিহ্নিত করে এর সমাধানের পথ নির্দেশ প্রদান করা। ১৩. ধর্মীয় নেতৃবৃন্দকে সমাজের মূল স্রোতধারার সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করা। ১৪. সন্ত্রাস বি¯Íারে সাম্রাজ্যবাদীদের ভ‚মিকা তুলে ধরা। ১৫. ধার্মিকেরাই যে মানবতার পরম বন্ধু তার বা¯Íব প্রমাণ পেশ করা।

[ লেখক : সহযোগী অধ্যাপক,

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।]