এপ্রিল ফুল থেকে মুসলিম উম্মাহ কোন শিক্ষা নেয়নি

৭১১ খ্রিষ্টাব্দে উমাইয়া শাসনামলে বীর মুজাহিদ তারিক বিন জিয়াদ ভূমধ্যসাগরের উত্তর তীরস্থ স্পেনের জনগণকে রক্ষা করেছিলেন রাজা রডরিকের অসহনীয় দুঃশাসন থেকে। জিয়াদ স্পেনে ইসলামের শাশ্বত সৌন্দর্য ও কল্যাণের যে সূত্রপাত করেছিলেন স্পেনবাসী সুদীর্ঘ ৮০০ বছর ধরে এর সুফল ভোগ করেছিল। স্পেনের সোনালী যুগের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে গ্রানাডা, আন্দালুসিয়া আল হামরা, কর্ডোভা, সেভিল, টলোডা। জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিস্ময়কর উন্নতির ফলে দেশটিতে তখন ছিল অর্থ সম্পদ, বিত্ত-বৈভবের অঢেল জোয়ার। কিন্তু মুসলমান শাসকরা কুরআন ও সুন্নাহর আদর্শ বিস্মৃত হয়ে পড়ায় এবং বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেয়ার ফলে তাদের জীবনে সীমাহীন দুর্ভোগই কেবল নেমে আসেনি বরং মুসলমানদের অস্তিত্ব পর্যন্ত বিলীন হয়ে গেছে স্পেনের মাটি থেকে।
তরবারির জোরে মুসলমানরা দীর্ঘ ৮০০ বছর স্পেন শাসন করেনি। জোর-জুলুম করলে স্পেনে কোন অমুসলিমই থাকার কথা ছিল না। তবে, মুসলমানদের দুর্বলতার সুযোগ খ্রিষ্টান নৃপতিরা স্পেনের মাটি থেকে মুসলমানদের উচ্ছেদ করতে ঠিকভাবেই কাজে লাগিয়েছিলেন। তাদের ধারণা ছিল পিরেনিজ পর্বতমালা অতিক্রমকারী দুর্ধর্ষ মুসলিম বাহিনীকে যদি পশ্চাৎপসরণে বাধ্য করা না যায় তবে হয়তো আগামী দিনগুলোতে ইউরোপের সব গির্জা থেকে আজানধ্বনি শোনা যাবে। তাই পর্তুগিজ রাণী ইসাবেলা চরম মুসলিম বিদ্বেষী পার্শ্ববর্তী রাজ্যের খ্রিষ্টান রাজা ফার্ডিন্যান্ডের সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর দু’জনে মিলে মুসলিম নিধনের নেতৃত্ব দেন। তারা স্পেনের মুসলিম শাসনকর্তা হাসানকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে না পেরে তারই পুত্র আবু আব্দুল্লাহকে সুকৌশলে হাত করেন। খ্রিষ্টানদের যৌথবাহিনী হাজার হাজার নিরীহ মুসলিম নারী ও পুরুষ শিশুকে হত্যা করে। তারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে উল্লাস করতে করতে রাজধানী গ্রানাডার দিকে ছুটে আসে। তারা আশপাশের সব শস্যখামারও জ্বালিয়ে দেয়। শহরের খাদ্য সরবরাহের প্রধান কেন্দ্র ভেগা উপত্যকা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। যার ফলে চরম দুর্ভিক্ষ নেমে আসে গ্রানাডা শহরে।
দুর্ভিক্ষ প্রকট আকার ধারণ করলে প্রতারক ফার্ডিন্যান্ড মুসলমানদের উদ্দেশে এই মিথ্যা আশ্বাস ঘোষণা করে, মুসলমানরা যদি শহরের প্রধান ফটক খুলে দেয় এবং নিরস্ত্র অবস্থায় মসজিদে আশ্রয় নেয় তবে তাদের ওপর আক্রমণ করা হবে না, তাদেরকে হত্যা করা হবে না এবং মুক্তি দেয়া হবে।
চরম দুর্ভিক্ষ তাড়িত গ্রানাডাবাসী মুসলমানরা ফার্ডিন্যান্ডের ধোঁকা বুঝতে না পেরে, অবোধ শিশু ও নারীদের কথা ভেবে, তার আশ্বাসে বিশ্বাস করে। তারা শহরের প্রধান ফটক খুলে দেয়। সরল বিশ্বাসে সবাইকে নিয়ে মসজিদে আশ্রয় নেয়। তখন ফার্ডিন্যান্ডের নির্দেশে সৈন্য বাহিনী শহরে প্রবেশ করে। মুসলমানদেরকে মসজিদের ভেতরে আটকিয়ে রেখে একযোগে শহরের সবকটি মসজিদে আগুন লাগিয়ে দিয়ে বর্বর উল্লাসে মেতে ওঠে। লক্ষ লক্ষ অসহায় নারী-পুরুষ ও শিশুর আর্তনাদে গ্রানাডার আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। মুসলমানরা মসজিদের ভেতরেই জীবন্ত দগ্ধ হয়। এ দিনটি ছিল ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দের ১ এপ্রিল। দীর্ঘ ৮০০ বছরব্যাপী মুসলিম শাসনের অবসান ঘটিয়ে রাজা ফার্ডিন্যান্ড এবং রাণী ইসাবেলা তখন ক্রুর হাসি হেসে উচ্চকণ্ঠে বলে বলেছিলেন ’ অঢ়ৎরষ ভড়ড়ষ ’, হায় এপ্রিলের বোকা!’ শত্রুর আশ্বাসে বিশ্বাস করে প্রতারিত হয় মুসলিমরা।
মুসলমানদের বোকা বানানোর এই নিষ্ঠুর খেলাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যই তারা প্রতি বছর ‘১ এপ্রিল’ মহা আনন্দের সাথে পালন করে থাকে। অজ্ঞতাবশত মুসলিম ছেলে-মেয়েরাও এপ্রিল ফুল পালন করে আসছে। আজতক মুসলিম উম্মাহ এই দিনটিকে শোক দিবস হিসেবে পালন করার ঘোষণাদানের বিজ্ঞতা দেখাতে পারেনি। সংগৃহীত ইত্তফাক

হযরত মুহাম্মদ(সঃ) এর বিদায় হজ্বের ভাষন

দশম হিজরীর যিলক্বদ মাসে রাসূলে পাক (স:) হজ্ব করার মনন্থ করেছিলেন। সংবাদটি পলকের মধ্যে সর্বত্র ছড়িয়ে গেল। সারা আরবের লোক হজ্বে অংশগ্রহণের জন্য উদ্বেলিত হয়ে উঠল। যিলক্বদের ২৬ তারিখ রোজ শনিবার রাসূলে পাক (স:) গোসল করলেন। তারপর তিনি লুঙ্গি ও চাদর পরিধান করলেন। জোহর নামায আদায় করার পর মদীনা থেকে দু’মাইল দূরে যুলহুলাইফা নামক একটি স্থান আছে। মদীনাবাসীদের হজ্বের এহরাম বাঁধার মীকাত এটাই। এখানে পৌঁছে রাত কাটালেন। পরদিন পুনরায় গোসল করলেন। হযরত আয়েশা (রা:) নিজ হাতে রাসূলে পাক (স:)-এর দেহ মুবারকে আতর মেখে দিলেন। তারপর রাসূলে পাক (স:) দু’রাকাত নামায আদায় করলেন। অতঃপর কাছওয়া নামক উটনীর পিঠে আরোহণ করে হজ্বের এহরাম বাঁধলেন। তারপর বুলন্দ আওয়াজে পাঠ করতে লাগলেন, ‘‘লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা, লাব্বাইকা-লা শারীকালাকা লাব্বাইকা ইন্নাল হামদা অননি’মাতালাকা অল মুলকা লা শারীকালাকা’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি হাজির হয়েছি, হে আল্লাহ! আমি হাজির হয়েছি, হে আল্লাহ! আমি হাজির হয়েছি এবং ঘোষণা করছি, তোমার কোন অংশীদার বা শরীক নেই। হে আল্লাহ! আমি হাজির হয়েছি নিশ্চয়ই সমুদয় প্রশংসা ও নিয়ামত তোমারই জন্য নিবেদিত এবং আধিপত্য ও সার্বভৌমত্ব কেবল তোমারই জন্য। তোমার কোন অংশীদার নেই। হযরত জাবের (রা:) এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি তাকিয়ে দেখলাম ডানদিকে এমনকি সর্বত্র জনতার ঢল নেমে এসেছে। বস্তুতঃ রাসূলে পাক (সা:) যখন লাব্বাইকা শব্দটি উচ্চারণ করতেন, তখন সাথে সাথে সহস্র কণ্ঠে একই শব্দ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে পাহাড়-পর্বত ও প্রান্তর প্রকম্পিত করে তুলত। মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে রাসূলে পাক (স:) যেসব স্থানে অবস্থান করে নামায আদায় করেছিলেন, সেসব স্থানে প্রাণপ্রিয় লোকজন বরকতের নিয়তে বহু মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। হজ্বের যাত্রাপথে রাসূলে পাক (স:) সেসব স্থানে যাত্রা বিরতি করে নামায পড়েছেন। তারপর সরফ নামক স্থানে পৌঁছে রাসূলে পাক (স:) গোসল করলেন। পরদিন রবিবার যিলহজ্ব মাসের চার তারিখ ছোবহে ছাদেকের সময় তিনি পবিত্র মক্কায় প্রবেশ করলেন। মদীনা থেকে মক্কা পর্যন্ত এই সফর নয় দিনে অতিক্রম করেছিলেন। বনু হাশেমের শিশু-কিশোররা রাসূলে পাক (সা:)-এর আগমনের সংবাদ শুনে খুশিতে মাতোয়ারা হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিল। রাসূলে পাক (স:) স্নেহ বাৎসল্যে কাউকে উটের পিঠে সামনে এবং কাউকে পেছনে বসিয়ে নিয়েছিলেন। তারপর যখন কা’বা শরীফ নজরে পড়ল, তখন তিনি দোয়া করলেন, হে আল্লাহ! আপনি এই গৃহের ইজ্জত, সম্মান ও মর্যাদা বাড়িয়ে দিন। অতঃপর কা’বা শরীফ তাওয়াফ করলেন এবং মাকামে ইব্রাহীমে দু’রাকাত নামায আদায় করলেন। তারপর এই আয়াত পাঠ করলেনঃ ‘আত্তাখিযূ মিম্মাক্বামি ইব্রাহীমা মুছাল্লা’ অর্থাৎ মাকামে ইব্রাহীমকে তোমরা নামাযের স্থান হিসেবে গ্রহণ কর।

তারপর ৮ যিলহজ্ব বৃহস্পতিবার সব মুসলমানকে সাথে নিয়ে রাসূলে পাক (স:) মিনায় চলে গেলেন। তারপর ৯ যিলহজ্ব শুক্রবার দিন ভোরে নামায পড়ে আরাফাতের দিকে রওয়ানা হলেন। ঐদিনটিই ছিল ইসলামের গৌরব এবং মর্যাদা বিকাশের দিন। যার ফলে অন্ধকার যুগের যাবতীয় অহেতুক ও বাতিল কাজকর্ম বিলুপ্ত হয়ে গেল। রাসূলে পাক (স:) এরশাদ করলেন, জেনে রেখ, অন্ধকার যুগের সব দস্তুর ও লোকচার আজ আমার পদতলে সংস্থাপিত হল।

রাসূলে পাক (স:) এরশাদ করলেন, হে লোকগণ! অবশ্যই তোমাদের প্রতিপালক এক এবং তোমাদের পিতাও এক; সুতরাং কোন আরবের কোন আজমের উপর প্রাধান্য নেই। শ্বেতবর্ণের লোকের কালো বর্ণের লোকের উপর এবং কালো বর্ণের লোকের শ্বেত বর্ণের লোকের উপর কোনই প্রাধান্য নেই; কিন্তু তাকওয়া ও পারহেজগারী হল মর্যাদার একমাত্র মানদণ্ড।

তার পর রাসূলে পাক (স:) বললেন, প্রত্যেক মুসলমান একে অন্যের ভাই এবং সব মুসলমান ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ। অতঃপর রাসূলে পাক (স:) বললেন, হে লোকগণ! তোমাদের গোলাম, তোমাদের গোলাম! যা তোমরা নিজেরা ভক্ষণ করবে তা তাদেরকেও খেতে দেবে। যা তোমরা পরিধান করবে তা তাদেরকেও পরিধান করাবে। আরবে কোন বংশের কেউ যদি কারো হাতে নিহত হত তবে এই হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করা বংশের উপর অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াত। এমনকি হাজার বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও এই ফরজ অবশিষ্ট থাকত। এতে করে যুদ্ধ ও রক্তপাতের এক অনন্তকালীন অধ্যায়ের সূচনা হত। এ কারণে আরবের যমিন সর্বদাই রক্তরঞ্জিত থাকত। তাই এসব আরবের পুরাতন পদ্ধতি ও লোকাচার, আভিজাত্যবোধ, বংশের গৌরব গাঁথার রেশ সর্বাংশে খতম করা হল। এর জন্য নবুয়তের এই ঘোষণা বিশ্ববাসীর সামনে সত্যিকার আদর্শের নমুনা পেশ করল। এই প্রেক্ষিতে ঘোষণা করা হল, অন্ধকার যুগের সব রক্তপাত বাতিল করে দেয়া হল এবং সর্বপ্রথম আমি আমার বংশের রক্ত অর্থাৎ রাবীআ বিন হারেছ-এর রক্তশোধ বাতিল ঘোষণা করলাম। ঘোষণা করা হল অন্ধকার যুগের সর্বপ্রকার সুদের কারবার বাতিল করা হল এবং সর্বপ্রথম আমার নিজের বংশের সুদ অর্থাৎ আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের সুদী কারবার বাতিল ঘোষণা করা হল। স্মরণ রাখা দরকার যে, রাসূলে পাক (স:)-এর চাচা আব্বাস (রা:) ইসলাম গ্রহণের পূর্বে সুদের কারবারে জড়িত ছিলেন। সেসময় সব লোকের কাছেই তিনি সুদের টাকা পাওনাদার ছিলেন। রাসূলে পাক (স:) তা বাতিল করে দিলেন। ঘোষণা করলেন, তোমরা নারীদের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় কর। অবশ্যই তাদের হক তোমাদের উপর আছে এবং তোমাদের হকও তাদের উপর আছে। আরবের জান ও মালের কোন মূল্য ছিল না। তারা ইচ্ছানুযায়ী যাকে ইচ্ছা তাকেই হত্যা করত এবং মানুষের কাছ থেকে জোরপূর্বক ধন-সম্পদ ছিনিয়ে নেয়া হত। তাই শান্তি ও নিরাপত্তা প্রদানকারী সম্র্রাট রাসূলে পাক (স:) সারা দুনিয়ার সামনে সন্ধি, স্বস্তি ও নিরাপত্তার আশ্বাস প্রদান করলেন এবং ঘোষণা করলেন, তোমাদের ধন-সম্পদ, তোমাদের রক্ত কিয়ামত পর্যন্ত এমনি হারাম যেমন, এই মাসে, এই দিনে, এই স্থানে এইসব বস্তু হারাম। এই নির্দেশ তোমাদের আল্লাহ পাকের সামনে হাজির হওয়া পর্যন্ত বলবত থাকবে। আমি তোমাদের কাছে একটি জিনিস রেখে যাচ্ছি। তোমরা তা দৃঢ়ভাবে ধরে রাখলে কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। ঐ বস্তুটি হল, আল্লাহর কিতাব। এরপর রাসূলে পাক (স:) কতিপয় বিধান জারি করলেন। হুকুম করা হল, আল্লাহর পাক সব হকদারকে তাদের ন্যায্য হক প্রদান করেছেন; সুতরাং এখন কোন উত্তরাধিকারীর জন্য অছীয়ত করবার দরকার নেই। জেনে রেখো, ছেলে ঐ ব্যক্তির বলেই সাব্যস্ত হবে যার শয্যায় সে জন্ম লভ করেছে। আর ব্যাভিচারের শাস্তি হল প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা এবং তার হিসাব আল্লাহ পাকই গ্রহণ করবেন। আর যে ছেলে নিজের পিতার বদলে অন্য কারো ঔরসে জন্ম নিয়েছে বলে দাবি করে এবং গোলাম স্বীয় মনিব ছাড়া অন্য কারো মালিকানায় নিজেকে সংযুক্ত করে তার উপর আল্লাহর অভিসম্পাত অবধারিত। আর মহিলাদের স্বামীর সম্পত্তিতে তাদের সম্পত্তি ছাড়া কোন কিছু দান করা জায়েয নয়। ধার করা বস্তু অবশ্যই ফেরত দিতে হবে। উপহারের বদলা উপহার প্রদান করতে হবে এবং কোন বস্তুর জিম্মাদার হলে এর পরিপূরণ অবশ্যই তাকে করতে হবে। তারপর রাসূলে পাক (স:) অগণিত জনসমুদ্রের প্রতি লক্ষ্য করে বললেন, আল্লাহ তোমাদেরকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। তোমরা এর কি উত্তর দেবে? ছাহাবীগণ বললেন, আমরা বলব, আপনি আল্লাহর পয়গাম পৌঁছে দিয়েছেন, আপনার কর্তব্য আদায় করেছেন। এর সময় রাসূলে পাক (সা:) আকাশের দিকে আঙ্গুলি উত্তোলন করে বললেন, হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন, হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন, হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন। রাসূলে পাক (স:)-এর আরাফাতের ময়দানে ভাষণদানকালেই এই আয়াত অবতীর্ণ হয়, “আল ইয়াওমা আমালতু লাকুম দ্বীনাকুম ওয়া আতমামতু আলাইকুম নি’মাতী ওয়া রাদ্বীতু লাকুমুল ইসলামা দ্বীনা।” অর্থাৎ আজ আমি তোমাদের জন্য দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং আমার নিয়ামত তোমাদের উপর পরিপূর্ণ করলাম। আর তোমাদের ধর্ম হিসেবে ইসলামকে মনোনীত করলাম।

হে লোক সকল! তোমরা কি জান আজকের দিনটি কোন দিন? লোকজন উত্তর করল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। রাসূলে পাক (স:) দীর্ঘ সময় নিশ্চুপ রইলেন। এতে লোকজন মনে করল, হয়তো রাসূলে পাক (স:) এই দিনটির নতুন করে কোন নামকরণ করবেন। দীর্ঘ সময় চুপ থাকার পর রাসূলে পাক (স:) বললেন, এটা কি কুরবানীর দিন নয়? লোকজন বলল, অবশ্যই কুরবানীর দিন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এটা কোন মাস? লোকজন পূর্ববৎ উত্তর দিল। রাসূলে পাক (স:) অনেক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, এটা কি যিলহজ্জের মাস নয়? লোকজন বলল, হাঁ, নিশ্চয়ই যিলহজ্জ মাস। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, বল দেখি এটা কোন শহর? লোকজন আগের মতই উত্তর দিল। রাসূলে পাক (স:) দীর্ঘক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর বললেন, এটা কি শহরে হারাম নয়? লোকজন বলল, হাঁ, অবশ্যই সম্মানিত শহর। যখন শ্রোতাদের মনে এই দিন এই মাস ও এই শহরের মর্যাদা ও সম্মান নতুন করে জেগে উঠল এবং তারা বিশ্বাস করল যে, এই দিনে এই মাসে, এই শহরে যুদ্ধ-বিগ্রহ ও রক্তপাত জায়েয নয়, তখন তিনি এরশাদ করলেন, তোমাদের রক্ত, তোমাদের মাল-সম্পদ ও তোমাদের ইযযত-হুরমত (কিয়ামত পর্যন্ত) এভাবেই পবিত্র। যেমন- এই দিন, এই মাস ও এই শহর সম্মানিত ও পবিত্র।

তিনি বুলন্দ আওয়াজে ঘোষণা করলেন, হে লোকগণ! তোমরা পরে যেন গোমরাহ হয়ে যেও না, একে অন্যের গর্দান উড়িয়ে দেয়ার মাধ্যমে। তোমাদেরকে আল্লাহর সামনে হাজির হতে হবে এবং তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে তোমাদের কৃত-কর্মের ব্যাপারে। তিনি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করলেন, জেনে রেখ, অপরাধী নিজের অপরাধের জন্য দায়ী থাকবে আর পিতার অপরাধের ভার ছেলে বহন করবে না। এমন কি ছেলের অপরাধের জবাবও পিতাকে দিতে হবে না। রাসূলে পাক (স:) এরশাদ করলেন, যদি হাবশী অন্ধ গোলামও তোমাদের আমীর হয় এবং আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদেরকে পথ প্রদর্শন করে, তবে তার ফরমাবরদার হওয়াও তোমাদের কর্তব্য। মরু আরবের প্রতিটি ধূলিকণা ইসলামের নূরে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল এবং খানায়ে কা’বা চিরকালের জন্য মিল্লাতে ইব্রাহিম (আ:)-এর প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। সত্য প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে যাবতীয় অশুভ বস্তু নির্মূল হয়ে যাচ্ছিল। এই অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখেই রাসূলে পাক (স:) এরশাদ করেছিলেন, জেনে রেখ, শয়তান অবশ্যই জেনে গেছে যে, রোজ কিয়ামত পর্যন্ত তোমাদের এই শহরে তার ইবাদাত-বন্দেগী কখনো হবে না। তবে হাঁ, কিছু কিছু ছোট-খাট কাজে তোমরা তার পায়রবী করলেও এতেই সে সন্তুষ্ট থাকবে। সর্বপ্রথম রাসূলে পাক (স:) ইসলামের প্রাথমিক ফরজগুলো তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। একই সাথে এরশাদ হল, “স্বীয় প্রতিপালকের ইবাদাত কর। পাঁচ ওয়াক্তের নামায আদায় কর, রমজান মাসের রোযা রাখ এবং নেতা ও আমীরের নির্দেশাবলীর আনুগত্য কর। তাহলে তোমরা বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে।” আমি তোমাদের মাঝে দু’টি বস্তু রেখে যাচ্ছি যা আঁকড়ে ধরলে কখনো কেউ পথভ্রষ্ট হবে না তা হলো- কুরআন ও আমার সুন্নাত।

এতটুকু বলার পর তিনি জনসমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি কি তোমাদের কাছে আল্লাহর পয়গাম পৌঁছে দিয়েছি? সবাই সমস্বরে বলে উঠল, হাঁ, আপনি দায়িত্ব পূর্ণ করেছেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক। অতঃপর জনসমুদ্রকে লক্ষ্য করে বললেন, যারা এখন এখানে উপস্থিত আছো, তারা এই ভাষণ অন্যদের কাছে পৌঁছে দেবে যারা এখানে উপস্থিত নেই। খুৎবাহর শেষ পর্যায়ে তিনি সব মুসলমানকে লক্ষ্য করে বললেন, বিদায়, বিদায়। সংগৃহীত ইত্তেফাক

ইসলাম পরিচিতি

ইসলাম

ইসলাম নামকরন কেন

দুনিয়ায় যত রকম ধর্ম রয়েছে তার প্রত্যেকটির নামকরণ হয়েছে কোন বিশেষ ব্যক্তির নামে। অথবা যে জাতির মধ্যে তার জন্ম হয়েছে তার নামে। যেমন, ঈসায়ী ধর্মের নাম রাখা হয়েছে তার প্রচারক হযরত ঈসা (আ)- এর নামে। বৌদ্ধ ধর্ম মতের নাম রাখা হয়েছে তার প্রতিষ্ঠাতা মহাত্মা বুদ্ধের নামে। জেরদশতি ধর্মের নামও হয়েছে তেমনি তার প্রতিষ্ঠাতা জরদশতের নামে। আবার ইয়াহুদী ধর্ম জম্ম নিয়েছিল ইয়াহুদা নামে বিশেষ গোষ্ঠীর মধ্যে। দুনিয়ায় আরো যেসব ধর্ম রয়েছে, তাদেরর নামকরণ হয়েছে এমনিভাবে। অবশ্য নামের দিক দিয়ে ইসলামের রয়েছে একটি অসাধারণ বৈশিষ্ট্য। কোন বিশেষ ব্যক্তি অথবা জাতির সাথে তার নামের সংযোগ নেই। বরং ‘ইসলাম’ শব্দটির অর্থের মধ্যের আমরা একটি বিশেষ গুণের পরিচয় পাই, সেই গুণই প্রকাশ পাচ্ছে এ নামে। নাম থেকেই বুঝা যায় যে, ইসলাম কোন এক ব্যক্তির আবিষ্কার নয়, কোন এক জাতির মধ্যে এ ধর্ম সীমাবদ্ধ নয়। ইসলাম কোন বিশেষ ব্যক্তি, দেশ অথবা জাতির সম্পত্তি নয়। তার উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের মধ্যে ইসলামের গুণরাজি সৃষ্টি করা। প্রত্যেক যুগে প্রত্যেক কওমের যেসব খাঁটি ও সৎলোকের মধ্যে এসব গুণ পাওয়া গেছে, তারা ছিলেন ‘মুসলিম’। এ ধরনের লোক আজো রয়েছেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন।
ইসলাম শব্দটির অর্থ

আরবী ভাষায় ‘ইসলাম’ বলতে বুঝায় আনুগত্য ও বাধ্যতা। আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও তার বাধ্যতা স্বীকার করে নেয়া এ ধর্মের লক্ষ্য বলেই এর নাম হয়েছে ‘ইসলাম’।
ইসলামের তাৎপর্য

সকলেই দেখতে পাচ্ছে যে, চন্দ্র, সূর্য, তারা এবং বিশ্বের যাবতীয় সৃষ্টি চলছে এক অপরিবর্তনীয় বিধান মেনে। সেই বিধানের বিন্দুমাত্র ব্যতিক্রম হবার উপায় নেই। দুনিয়া এক নির্দিষ্ট গতিতে ঘুরে চলছে এক নির্দিষ্ট পথ অতিক্রম করে। তার চলার জন্য যে সময়, যে গতি ও পথ নির্ধারিত রয়েছে, তার কোন পরিবর্তন নেই কখনো। পানি আর হাওয়া, তাপ আর আলো- সব বিছুই কাজ করে যাচ্ছে এক সঠিক নিয়মের অধীন হয়ে। জড়, গাছপালা, পশু-পাখীর রাজ্যেরও রয়েছে তাদের নিজস্ব নিয়ম। সেই নিয়ম মুতাবিক তারা পয়দা হয়, বেড়ে ওঠে, ক্ষয় হয়, বাঁচে ও মরে। মানুষের অবস্থা চিন্তা করলে দেখতে পাই যে, সেও এক বিশেষ প্রাকৃতিক নিয়মের অধীন। এক নির্দিষ্ট জীবতাত্ত্বিক বিধান অনুযায়ী সে জম্মে, শ্বাস গ্রহণ করে, পানি, খাদ্য, তাপ ও আলো আত্মস্থ করে বেঁচে থাকে। তার হৃৎপিন্ডের গতি, তার দেহের রক্তপ্রবাহ, তার শ্বাস-প্রশ্বাস একই বাঁধাধরা নিয়মের অধীন হয়ে চলছে। তার মস্তিষ্ক, পাকস্থলী, শিরা-উপশিরা, পেশীসমূহ, হাত, পা, জিভ, কান, নাক-- এক কথায় তার দেহের প্রতিটি অংগ- প্রত্যংগ কাজ করে যাচ্ছে সেই একই পদ্ধতিতে যা তাদের প্রত্যেকের জন্য নির্ধারিত হয়েছে।

যে শক্তশালী বিধানের অধীনে চলতে হচ্ছে দুনিয়া জাহানের বৃহত্তম নক্ষত্র থেকে শুরু করে ক্ষুদ্রতম কণিকা পর্যন্ত সবকিছু, তা হচ্ছে এক মহাশক্তিমান বিধানকর্তার সৃষ্টি। সমগ্র সৃষ্টি এবং সৃষ্টির প্রতিটি পদার্থ এ বিধানকর্তার আনুগত্য স্বীকার করে এবং সবাই মেনে চলে তাঁরই দেয়া নিয়ম। আগেই আমি বলেছি যে, দুনিয়া- জাহানের প্রভু আল্লাহ তা’য়ালার আনুগত্য ও তারই নিকট আত্মসমর্পণের নামই ইসলাম, তাই এদিক দিয়ে সমগ্র সৃষ্টির ধর্মই হচ্ছে ইসলাম। চন্দ্র, সূর্য, তারা গাছপালা, পাথর ও জীব-জানোয়ার সবাই মুসলিম! যে মানুষ আল্লাহকে চেনে না, যে তাঁকে অস্বীকার করে, যে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে পূজা করে এবং যে আল্লাহর কর্তৃত্বের ক্ষেত্রে অন্য কাউকে অংশীদার করে, স্বভাব-প্রকৃতির দিক দিয়ে সেও মুসলিম, কারণ তার জীবন-মৃত্যু সব কিছুই আল্লাহর বিধানের অনুসারী। তার প্রতিটি অংগ-প্রত্যংগ, তার দেহের প্রতিটি অণু ইসলাম মেনে চলে কারণ তার সৃষ্টি, বৃদ্ধি ও গতি সবকিছুই আল্লাহর দেয়া নিয়মের অধীন। মূর্খতাবশত যে জিহবা দিয়ে সে শিরক ও কুফরের কথা বলছে, প্রকৃতির দিক দিয়ে তাও মুসলিম। যে মাথাকে জোরপূর্বক আল্লাহ ছাড়া অপরের সামনে অবনত করছে, সেও জম্মগতভাবে মুসলিম, অজ্ঞতার বশে যে হৃদয় মধ্যে সে অপরের প্রতি সম্মান ও ভালবাসা পোষণ করে, তাও সহজাত প্রকৃতিতে মুসলিম। তারা সবাই আল্লাহর নিয়মের অনুগত এবং তাদের সব কাজ চলছে এ নিয়মের অনুসরন করে।

এবার আর এক আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাপারটি বিবেচনা করে দেখা যাক।

প্রকৃতির লীলাখেলার মধ্যে মানুষের অস্তিত্বের রয়েছে দু’টি দিক। এক দিকে সে অন্যান্য সৃষ্টির মতোই জীব-জগতের নির্দিষ্ট নিয়মে বাঁধা রয়েছে। তাকে মেনে চলতে হয় সেই নিয়ম। অপরদিকে, তার রয়েছে জ্ঞানের অধিকার, চিন্তা করে বুঝে কোন বিশেষ সিদ্ধান্তে পৌছার ক্ষমতা তার করায়ত্ত। নিজের ইখতিয়ার অনুযায়ী কোন বিশেষ মতকে সে মেনে চলে, আবার কোন বিশেষ মতকে সে অমান্য করে কোন পদ্ধতি সে পছন্দ করে, কোন বিশেষ পদ্ধতিকে আবার পছন্দ করে না। জীবনের কার্যকলাপের ক্ষেত্রে কখনো কোন নিয়ম-নীতিকে সে স্বেচ্ছায় তৈরী করে নেয়, কখনো বা অপরের তৈরী নিয়ম-নীতিকে নিজের করে নেয়। এদিক দিয়ে সে দুনিয়ার অন্যবিধ সৃষ্ট পদার্থের মতো একই ধরাবাঁধা নিয়মের অধীন নয়, বরং তাকে দেয়া হয়েছে নিজস্ব চিন্তা, মতামত ও কর্মের স্বাধীনতা।

মানবজীবনে এ দু’টি দিকেরই রয়েছে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব। প্রথম বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে মানুষ দুনিয়ার অপর সব পদার্থের মতই জম্মগত মুসলিম এবং আমি আগে যা বলেছি সেই অনুসারে মুসলিম হতে সে বাধ্য। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে মুসলিম হওয়া বা না হওয়ার উভয়বিধ ক্ষমতা তার মধ্য রয়েছে এবং এ নির্বাচন ক্ষমতার প্রভাবেই মানুষ বিভক্ত হয়েছে দু’টি শ্রেণীতে।

এক শ্রেনীর মানুষ হচ্ছে তারা, যারা তাদের স্রষ্টাকে চিনেছে, তাকেই তাদের একমাত্র মনিব ও মালিক বলে মেনে নিয়েছে এবং যে ব্যাপারে তাদেরকে নির্বাচনের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, সেখানেও তারই নির্ধারিত কানুন মেনে চলবার পথই তারা বেছে নিয়েছে, তারা হয়েছে পরিপূর্ণ মুসলিম। তাদের ইসলাম হয়েছে পূর্ণাঙ্গ। কারণ তাদের জীবনই পরিপূর্ণরূপে আল্লাহতে সমর্পিত। না জেনে-শুনে যার নিয়মের আনুগত্য তারা করছে জেনে-শুনেও তারই আনুগত্যের পথই তারা অবলম্বন করেছে। অনিচ্ছায় তারা আল্লাহর বাধ্যতার পথে চলেছিল, স্বেচ্ছায়ও তারই বাধ্যতার পথ তারা বেছে নিয়েছে। তারা হয়েছে এখন সত্যিকার জ্ঞানের অধিকারী। কারণ যে আল্লাহ তাদেরকে দিয়েছেন জানবার ও শিখবার ক্ষমতা, সেই আল্লাহকেই তারা জেনেছে। এখন তারা হয়েছে সঠিক যুক্তি ও বিচার ক্ষমতার অধিকারী। কারণ, যে আল্লাহ তাদেরকে চিন্তা করবার, বুঝবার ও সঠিক সিদ্ধান্ত কায়েম করবার যোগ্যতা দিয়েছে। তাদের জিহবা হয়েছে সত্যভাষী, কেননা সেই প্রভুত্বের স্বীকৃতি ঘোষণা করেছে তারা, যিনি তাদেরকে দিয়েছেন কথা বলার শক্তি। এখন তদের পরিপূর্ণ জীবনই হয়েছে পূর্ণ সত্যাশ্রয়ী। কারণ ইচ্ছা-অনিচ্ছায় উভয় অবস্থায়ই তারা হয়েছে একমাত্র আল্লাহর বিধানের অনুসারী। সমগ্র সৃষ্টির সাথেই তাদের মিতালী। কারণ সৃষ্টির সকল পদার্থ যার দাসত্ব করে যাচ্ছে, তারাও করেছে তারই দাসত্ব। দুনিয়ার বুকে তারা হচ্ছে আল্লাহর খলীফা (প্রতিনিধি) সারা দুনিয়া এখন তাদেরই এবং তারা হচ্ছে আল্লাহর।
কুফরের তাৎপর্য

যে মানুষের কথা উপরে বলা হলো, তার মুকাবিলায় রয়েছে আর এক শ্রেনীর মানুষ। সে মুসলিম হয়েই পয়দা হয়েছে এবং না জেনে, না বুঝে জীবনভর মুসলিম হয়েই থেকেছে। কিন্তু নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধির শক্তিকে কাজে লাগিয়ে সে আল্লাহকে চেনেনি এবং নিজের নির্বাচন ক্ষমতার সীমানার মধ্যে সে আল্লাহর আনুগত্য করতে অস্বীকার করেছে। এ ধরনের লোক হচ্ছে কাফের। ‘কুফর’ শব্দটির আসল অর্থ হচ্ছে কোন কিছু ঢেকে রাখা বা গোপন করা। এ ধরনের লোকে ‘কাফের’ (গোপনকারী) বলা হয়, কারণ সে তার আপন স্বভাবের উপর ফেলেছে অজ্ঞতার পর্দা। সে পয়দা হয়েছে ইসলামী স্বভাব নিয়ে। তার সারা দেহ ও দেহের প্রতিটি অংগ কাজ করে যাচ্ছে ইসলামী স্বভাবেরই উপর তার পারিপার্শ্বিক সারা দুনিয়ার এবং তার নিজের সহজাত প্রকৃতি সরে গেছে তার দৃষ্টি থেকে। সে এ প্রকৃতির বিপরীত চিন্তা করেছে। তার বপরীতমূখী হয়ে চলবার চেষ্টা করেছে।

এখন বুঝা গেল, যে মানুষ কাফের, সে কত বড় বিভ্রান্তিতে ডুবে আছে।
কুফরের অনিষ্টকারিতা

'কুফর’ হচ্ছে এক ধরনের মূর্খতা, বরং কুফরই হচ্ছে আসল মূর্খতা। মানুষ আল্লাহকে না চিনে অজ্ঞ হয়ে থাকলে তার চায়ে বড় মূর্খতা আর কি হতে পারে? এক ব্যক্তি দিন-রাত দেখেছে, সৃষ্টির এত বড় বিরাট কারখানা চলেছে, অথচ সে জানে না, কে এ কারখানার স্রষ্টা ও চালক। কে সে কারিগর, যিনি কয়লা, লোহা, ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম ও আরো কয়েকটি পদার্থ মিলিয়ে অস্তিত্বে এনেছেন মানুষের মত অসংখ্য অতুলনীয় সৃষ্টিকে? মানুষ দুনিয়ার চারিদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখতে পাচ্ছে এমন সব বস্তু ও কার্যকলাপ, যার ভিতরে রয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং, গণিতবিদ্যা, রসায়ন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার অপূর্ব পূর্ণতার নিদর্শন; কিন্তু সে জানে না, অসাধারণ সীমাহীন জ্ঞান- বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ কোন সে সত্তা চালিয়ে যাচ্ছেন সৃস্টির এসব কার্যকলাপ। ভাবা দরকার যে মানুষ জ্ঞানের প্রাথমিক স্তরের খবরও জানে না, কি করে তার দৃষ্টির সামনে উম্মুক্ত হবে সত্যিকার জ্ঞানের তোরণদ্বার? যতই চিন্তা-ভাবনা করুক, যতই অনুসন্ধান করুক, সে কোন দিকেই পাবে না সরল- সঠিক নির্ভরযোগ্য পথ, কেননা তার প্রচেষ্টার প্রারম্ভ ও সমাপ্তি সব স্তরেই দেখা যাবে অজ্ঞতার অন্ধকার।

কুফর একটি যুলুম, বরং সবচেয়ে বড় যুলুমই হচ্ছে এ কুফর। যুলুম কাকে বলে? যুলুম হচ্ছে কোন জিনিস থেকে তার সহজাত প্রকৃতির খেলাপ কাজ যবরদস্তি করে আদায় করে নেয়া? আগেই জানা গেছে যে, দুনিয়ায় যত জিনিস রয়েছে, সবাই আল্লাহর ফরমানের অনুসারী এবং তাদের সহজাত প্রকৃতি (ফিতরাত) হচ্ছে ‘ইসলাম’ অর্থাৎ আল্লাহর বিধানের আনুগত্য। মানুষের দেহ ও তার প্রত্যেকটি অংশ এ প্রকৃতির উপর জম্ম নিয়েছে। অবশ্যি আল্লাহ এসব জিনিসকে পরিচালনা করবার বিছুটা স্বাধীনতা মানুষকে দিয়েছেন, কিন্তু প্রত্যেকটি জিনিসের সহজাত প্রকৃতির দাবী হচ্ছে এই যে, আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে যেন কাজে লাগানো হয়। কিন্তু যে ব্যক্তি ‘কুফর’ করছে সে তাকে লাগাচ্ছে তার প্রকৃতি বিরোধী কাজে। সে নিজের দিলের মধ্যে অপরের শ্রেষ্ঠত্ব, প্রেম ও ভীতি পোষণ করছে অথচ তার দিলের প্রকৃতি দাবী করছে যে, সে তার মধ্যে একমাত্র আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রেম ও ভীতি পোষণ করবে। সে তার অংগ-প্রত্যংগ আর দুনিয়ায় তার আধিপত্যের অধীন সব জিনিসকে কাজে লাগাচ্ছে আল্লাহর ইচ্ছা বিরোধী উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, অথচ তাদের প্রকৃতির দাবী হচ্ছে তাদের কাছ থেকে আল্লাহর বিধান মুতাবিক কাজ আদায় করা। এমনি করে যে লোক জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে প্রত্যেকটি জিনিসের উপর এমন কি, নিজের অস্তিত্বের উপর ক্রমাগত যুলুম করে যাচ্ছে, তার চেয়ে বড় যালেম আর কে হতে পারে?

'কুফর’ কেবল যুলুমই নয়, বিদ্রোহ, অকৃতজ্ঞতা ও নেমকহারামিও বটে। ভেবে দেখা যাক, মানুষের আপন বলতে কি জিনিস আছে। নিজের মস্তিষ্ক সে নিজেই পয়দা করে নিয়েছে না আল্লাহ পয়দা করেছেন? নিজের দিল, চোখ, জিভ, হাত-পা, আর সব অংগ-প্রত্যংগ- সবকিছুর স্রষ্টা মানুষ না আল্লাহ? তার চারপাশে যত জিনিস রয়েছে, তার স্রষ্টা মানুষ না আল্লাহ এসব জিনিস মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় ও কার্যকরী করে তৈরী করা এবং মানুষকে তা কাজে লাগাবার শক্তি দান করা কি মানুষের নিজের না আল্লাহর কাজ? সকলেই বলবে, আল্লাহরই এসব জিনিস, তিনিই এগুলো পয়দা করেছেন, তিনিই সব কিছুর মালিক এবং আল্লাহর দান হিসেবেই মানুষ আধিপত্য লাভ করেছে এসব জিনিসের উপর। আসল ব্যাপার যখন এই তখন যে লোক আল্লাহর দেয়া মস্তিষ্ক থেকে আল্লাহরই ইচ্ছার বিপরীত চিন্তা করার সুবিধা আদায় করে নেয়, তার চেয়ে বড় বিদ্রোহী আর কে? আল্লাহ তাকে চোখ, জিভ, হাত-পা, এবং আরো কত জিনিস দান করেছেন, তা সবকিছুই সে ব্যবহার করেছে আল্লাহর পছন্দ ও ইচ্ছা বিরোধী কাজে। যদি কোন ভৃত্ব তার মনিবের নেমক খেয়ে তার বিশ্বাসের প্রতিকূল কাজ করে যায়, তবে তাকে সকলেই বলবে নেমকহারাম। কোন সরকারী অফিসার যদি সরকারের দেয়া ক্ষমতা সরকারের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে থাকে, তাকে বলা হবে বিদ্রোহী। যদি কোন ব্যক্তি তার উপকারী বন্ধুর সাথে প্রতারণা করে সকলেই বিনা দ্বিধায় তাকে বলবে অকৃতজ্ঞ। কিন্তু মানুষের সাথে মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা ও অকৃতজ্ঞতার বাস্তবতা কতখানি? মানুষ মানুষকে আহার দিচ্ছে কোত্থেকে? সে তো আল্লাহরই দেয়া আহার। সরকার তার কর্মচারীদেরকে যে ক্ষমতা অর্পণ করে, সে ক্ষমতা এলো কোত্থেকে? আল্লাহই তো তাকে রাজ্য পরিচালনার শক্তি দিয়েছেন। কোন উপকারী ব্যক্তি অপরের উপকার করছে কোত্থেকে? সবকিছুই তো আল্লাহর দান। মানুষের উপর সবচেয়ে বড় হক বাপ-মার অন্তরে সন্তান বাৎসল্য উৎসারিত করেছেন কে? মায়ের বুকে স্তন দান করেছেন কে? বাপের অন্তরে কে এমন মনোভাব সঞ্চার করেছেন, যার ফলে তিনি নিজের কঠিন মেহনতের ধন সানন্দে একটা নিষ্ক্রিয় মাংসপিন্ডের জন্য লুটিয়ে দিচ্ছেন এবং তার লালন-পালন ও শিক্ষার জন্য নিজের সময়, অর্থ ও সুখ- স্বাচ্ছন্দ্য কুরবান করে দিচ্ছেন? যে আল্লাহ মানুষের আসল কল্যাণকারী, প্রকৃত বাদশাহ, সবার বড় পরওয়ারদিগার, মানুষ যদি তার প্রতি অবিশ্বাস পোষণ করে, তাকে আল্লাহ বলে না মানে, তার দাসত্ব অস্বীকার করে, আর তার আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তার চেয়ে গুরুতর বিদ্রোহ, অকৃতজ্ঞতা ও নেমকহারামী আর কি হতে পারে।

কখনো মনে করা যেতে পারে না যে, কুফরি করে মানুষ আল্লাহর কোন অনিষ্ট করতে পারছে। যে বাদশাহর সাম্রাজ্য এত বিপুল-বিরাট যে, বৃহত্তম দূরবীন লাগয়েও আমরা আজো স্থির করতে পারিনি কোথায় তার শুরু আর কোথায় শেষ। যে বাদশাহ এমন প্রবল প্রতাপশালী যে, তার ইশারায় আমাদের এ পৃথিবী, সূর্য, মঙ্গলগ্রহ এবং আরো কোটি কোটি গ্রহ-উপগ্রহ বলের মতো চক্রাকারে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যে বাদশাহ এমন অফুরন্ত সম্পদশালী যে, সারা সৃষ্টির আধিপত্যে কেহ তার অংশীদার নেই, যে বাদশাহ এমন স্বয়ংসম্পূর্ণ ও আত্মনির্ভরশীল যে, সবকিছুই তার মুখাপেক্ষী অথচ তিনি কারুর মুখাপেক্ষী নন, মানুষের এমন কি অস্তিত্ব আছে যে তাকে মেনে বা না মেনে সেই বাদশাহর কোন অনিষ্ট করবে? কুফর ও বিদ্রোহের পথ ধরে মানুষ তার কোন ক্ষতি করতে পারে না, বরং নিজেই নিজের ধ্বংসের পথ খোলাসা করে।

কুফর ও নাফরমানীর অবশ্যম্বাবী ফল হচ্ছে এই যে, এর ফলে মানুষ চিরকালের জন্য ব্যর্থ ও হতাশ হয়ে যায়। এ ধরনের লোক জ্ঞানের সহজ পথ কখনো পাবে না, কারণ যে জ্ঞান আপন স্রষ্টাকে জানে না, তার পক্ষে আর কোন জিনিসের সত্যিকার পরিচয় লাভ অসম্ভব। তার বুদ্ধি সর্বদা চালিত হয় বাকা পথ ধরে, কারণ সে তার স্রষ্টার পরিচয় লাভ করতে গিয়ে ভুল করে, আর কোন জিনিসকেও সে বুঝতে পারে না নির্ভুলভাবে। নিজের জীবনের প্রত্যেকটি কার্যকলাপে তার ব্যর্থতার পর ব্যর্থতা অবধারিত। তার নীতিবোধ, তার কৃষ্টি, তার সমাজ ব্যবস্থা, তার জীবিকা অর্জন পদ্ধতি, তার শাসন-পরিচালনা ব্যবস্থা ও রাজনীতি, এক কথায় তার জীবনের সর্ববিধ কার্যকলাপ বিকৃতির পথে চালিত হতে বাধ্য। দুনিয়ার বুকে সে বিশৃংখলা সৃষ্টি করবে, খুন-খারাবি করবে, অপরের অধিকার হরণ করবে, অত্যাচার উৎপীড়ন করবে। বদখেয়াল, অন্যায়- অনাচার ও দুষ্কৃতি দিয়ে তার নিজের জীবনকেই করে তুলবে তিক্ত-বিস্বাদ। তারপর এ দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে সে যখন আখেরাতের দুনিয়ায় পৌছবে, তখন জীবনভর যেসব জিনিসের উপর সে যুলুম করে এসেছে, তারা তার বিরুদ্ধে নালিশ করবে। তার মস্তিষ্ক, তার দিল, তার চোখ, তার কান, তার হাত-পা এক কথায় তার সব অংগ-প্রত্যংগ আল্লাহর আদালতে অভিযোগ করে বলবেঃ এ আল্লাহদ্রোহী যালেম তার বিদ্রোহের পথে জবরদস্তি করে আমাদের কাছ থেকে কাজ আদায় করে নিয়েছে। যে দুনিয়ার বুকে সে নাফরমানীর সাথে চলেছে ও হারাম পথে রোযগার করে হারামের পথে ব্যয় করেছে, অবাধ্যতার ভিতর দিয়ে যেসব জিনিস সে জবরদখল করেছে, যেসব জিনিস সে তার বিদ্রোহের পথে কাজে লাগিয়েছে, তার সবকিছুই ফরিয়াদী হয়ে হাযির হবে তার সামনে এবং প্রকৃত ন্যায় বিচারক আল্লাহ সেদিন মযলুমদের প্রতি অন্যায়ের প্রতিকারে বিদ্রোহীকে দিবেন অপমানকর শাস্তি।
ইসলামের কল্যাণ

এতো গেলো কুফরের অনিষ্টকারিতা। এবার আমরা দেখবো ইসলামের পথ ধরলে কি কি কল্যাণ লাভ করা যায়।

উপরের বর্ণনা থেকে জানা গেছে যে, এ দুনিয়ার প্রত্যেক দিকে ছড়িয়ে রয়েছে আল্লাহর কর্তৃত্বের অসংখ্য নিদর্শন। সৃষ্টির এ বিপুল বিরাট যে কারখানা চলছে এক সুম্পন্ন বিধান ও অটল কানুনের অধীন হয়ে, তাই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, তার স্রষ্টা ও পরিচালক এক মহাশক্তিমান শাসক-- যার ব্যবস্থাপনায় কেউ অবাধ্য হয়ে থাকতে পারে না। সমগ্র সৃষ্টির মত মানুষেরও প্রকৃতি হচ্ছে তার আনুগত্য। কাজেই অচেতনভাবে সে রাত-দিন তারই আনুগত্য করে যাচ্ছে, কারণ তার প্রাকৃতিক নিয়মের প্রতিকুল আচরণ করে সে বেঁচেই থাকতে পারে না।

কিন্তু আল্লাহ মানুষকে জ্ঞান আহরণের যোগ্যতা, চিন্তা ও উপলব্ধি করার শক্তি এবং সৎ ও অসতের পার্থক্য বুঝবার ক্ষমতা দিয়ে তাকে ইচ্ছাশক্তি ও নির্বাচন ক্ষমতার কিছুটা আযাদী দিয়েছেন। আসলে এ আযাদীর ভিতরেই মানুষের পরীক্ষা, তার জ্ঞানের পরীক্ষা, তার যুক্তির পরীক্ষা, তার পার্থক্য অনুভূতির পরীক্ষা। এছাড়া তাকে যে আযাদী দেয়া হয়েছে, কিভাবে সে তা ব্যবহার করছে, তারও পরীক্ষা এর মধ্যে। এ পরীক্ষায় কোন বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করতে মানুষকে বাধ্য করা হয়নি, কারণ বাধ্যতা আরোপ করলে পরীক্ষার উদ্দেশ্যই হয় ব্যাহত। এ কথা প্রত্যেকেই বুঝতে পারে যে, প্রশ্নপত্র হাতে দেয়ার পর যদি পরীক্ষার্থীকে কোন বিশেষ ধরনের জবাব দিতে বাধ্য করা হয়, তাহলে সে ধরনের পরীক্ষা ফলপ্রসূ হয় না। পরীক্ষার্থীর আসল যোগ্যতা তা কেবল তখনই প্রমাণিত হবে, যখন তাকে প্রত্যেক ধরনের জবাব পেশ করবার স্বাধীনতা দেয়। সে সঠিক জবাব দিতে পারলে হবে সফল এবং আগামী উন্নতির দরযা খুলে যাবে তার সামনে। আর ভুল জবাব দিলে হবে অকৃতকার্য এবং অযোগ্যতার দরুন নিজেই নিজের উন্নতির পথ করবে অবরুদ্ধ। ঠিক তেমনি করেই আল্লাহ তা’য়ালা মানুষকে এ পরীক্ষায় যে কোন পথ অবলণম্বন করার স্বাধীনতা দিয়েছেন।

এ ক্ষেত্রে এখন এক ব্যক্তির কথা বলা যায়, যে নিজের ও সৃষ্টির সহজাত প্রকৃতি উপলব্ধ করেনি, স্রষ্টার সত্ত্বা ও গুণরাজি চিনতে যে ভুল করেছে এবং মুক্তবুদ্ধির যে স্বাধীনতা তাকে দেয়া হয়েছে, তার সাহায্যে না-ফরমানী ও অবাধ্যতার পথ অবলম্বন করে চলেছে। এ ব্যক্তি জ্ঞান, যুক্তি, পার্থক্য-অনুভূতি ও কর্তব্য নিষ্ঠার পরীক্ষায় ব্যর্থকাম হয়েছে। সে নিজেই প্রমাণ করে দিয়েছে যে, সে প্রত্যেক দিক দিয়েই নিকৃষ্ট স্তরের লোক। তাই উপরে বর্ণিত পরিণামই তার জন্য প্রতীক্ষা করছে।

অন্যদিকে রয়েছে আর এক ব্যক্তি, যে এ পরীক্ষায় সাফল্য লাভ করেছে সে জ্ঞান ও যুক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে আল্লাহকে জেনেছে ও মেনেছে, যদিও এ পথ ধরতে তাকে বাধ্য করা হয়নি। সৎ ও অসতের মধ্যে পার্থক্য করতে গিয়ে সে ভুল করেনি এবং নিজস্ব স্বাধীন নির্বাচন ক্ষমতা দ্বারা সে সৎ পথই বেছে নিয়েছে, অথচ অসৎ পথের দিকে চালিত হবার স্বাধীনতা তার ছিল। সে আপন সহজাত প্রকৃতিকে উপলব্ধি করেছে, আল্লাহকে চিনিছে এবং না-ফরমানীর স্বাধীনতা থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর আনুগত্যের পথ অবলম্বন করেছে। সে তার যুক্তিকে ঠিক পথে চালিত করেছে। চোখ দিয়ে ঠিক জিনিসই দেখেছে, কান দিয়ে ঠিক কথা শুনেছে, মস্তিষ্ক চালনা করে সঠিক সিদ্ধান্ত করেছে বলেই পরীক্ষায় সে সাফল্য-গৌরবের অধিকারী হয়েছে। সত্যকে চিনে নিয়ে সে প্রমাণ করেছে যে, সত্য সাধক এবং সত্যের সামনে মস্তক অবনত করে দেখিয়েছিল যে, সে সত্যের পূজারী।

এ কথায় সন্দেহ নেই যে, যার মধ্যে এসব গুণরাজির সমাবেশ হয়, সে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় ক্ষেত্রেই সাফল্যের অধিকারী হয়ে থাকে।

এ শ্রেণীর লোক জ্ঞান ও যুক্তির প্রত্যেক ক্ষেত্রেই সঠিক পথ অবলম্বন করবে, কারণ যে ব্যক্তি আল্লাহর সত্তাকে উপলব্ধি করেছে এবং তার গুণরাজির পরিচয় লাভ করেছে, সেই জ্ঞানের সূচনা থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত সবকিছুই জেনেছে এ ধরনের লোক কখনো বিভ্রান্তির পথে চলতে পারে না, কারণ শুরুতেই সে পদক্ষেপ করেছে সত্যের দিকে এবং তার সর্বশেষ গন্তব্য লক্ষ্যকেও সে জেনে নিয়েছে পূর্ণ বিশ্বাস সহকারে। এরপর সে দার্শনিক চিন্তা ও অনুসন্ধানের মারফতে সৃষ্টি রহস্য উদঘাটন করবার চেষ্টা করবে, কিন্তু কাফের দার্শনিকের মতো কখনো সংশয়-সন্দেহের বিভ্রান্তি-স্তূপের মধ্যে নিমজ্জিত হবে না । বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সে প্রাকৃতিক নিয়মকে উপলব্ধি করবার চেষ্টা করবে, সৃষ্টির লুক্কায়িত ধনভান্ডারকে নিয়ে আসবে প্রকাশ্য আলোকে। দুনিয়ায় ও মানুষের দেহে আল্লাহ যে শক্তিসমূহ সৃষ্টি করে দিয়েছেন, তার সবকিছুরই সন্ধান করে সে জেনে নেবে। যমীন ও আসমানে যত পদার্থ রয়েছে, তার সব কিছুকেই কাজে লাগাবার সর্বোত্তম পন্থার সন্ধান সে করবে, কিন্তু আল্লাহর প্রতি নিষ্ঠা তাকে প্রতি পদক্ষেপে ফিরিয়ে রাখবে বিজ্ঞানের অপব্যবহার থেকে। আমিই এসব জিনিসের মালিক, প্রকৃতিকে আমি জয় করেছি, নিজের লাভের জন্য আমি জ্ঞানকে কাজে লাগাব, দুনিয়ায় আনব ধ্বংস-তান্ডব, লুট-তরাজ ও খুন-খারাবী করে সারা দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠা করব আমার শক্তির আধিপত্য, এ জাতীয় বিভ্রান্তিকর চিন্তায় সে কখনো নিমজ্জিত হবে না। এ হচ্ছে কাফের বিজ্ঞানীর কাজ। মুসলিম বিজ্ঞানী যত বেশী করে বৈজ্ঞানিক কৃতিত্ব অর্জন করবে, ততোই বেরে যাবে আল্লাহর প্রতি তার বিশ্বাস এবং ততোই সে আল্লাহর কৃতজ্ঞ বান্দায় পরিণত হবে। তার মনোভাব হবেঃ আমার মালিক আমায় যে শক্তি দিয়েছেন এবং যেভাবে আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দিয়েছেন, তা থেকে আমার নিজের ও দুনিয়ার সকল মানুষের কল্যাণ সাধনের চেষ্টা আমি করবো। এ হচ্ছে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সঠিক পথ।

অনুরূপভাবে ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, আইন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যবিধ শাখায় মুসলিম তার গবেষণা ও কর্মতৎপরতার দিক দিয়ে কাফেরের পিছনে পড়ে থাকবে না, কিন্তু দু’জনের দৃষ্টিভংগি হবে স্বতন্ত্র। মুসলিম প্রত্যেক জ্ঞানের চর্চা করবে নির্ভুল দৃষ্টিভংগি নিয়ে, তার সামনে থাকবে এক নির্ভুল লক্ষ্য এবং সে পৌছবে এক নির্ভুল সিদ্ধান্তে। ইতিহাসে মানব জাতির অতীত দিনের পরীক্ষা থেকে সে গ্রহণ করবে শিক্ষা, খুঁজে বের করবে জাতিসমূহের উত্থান-পতনের সঠিক কারণ, অনুসন্ধান করবে তাদের তাহযীব তামাদ্দুসের কল্যাণের দিক। ইতিহাসে বিব্রত সৎ মানুষের অবস্থা আলোচনা করে সে উপকৃত হবে। যেসব কারণে অতীতের বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে, তা থেকে বেচে থাকবে। অর্থনীতি ক্ষেত্রে অর্থ উপার্জন ও ব্যয়ের এমন অভিনব পন্থা সে খুঁজে বের করবে, যাতে সকল মানুষের কল্যাণ হতে পারে, কেবল একজনের কল্যাণ ও অসংখ্য মানুষের অকল্যাণ তার লক্ষ্য হবে না। রাজনীতি ক্ষেত্রে তার পরিপূর্ণ মনোযোগ থাকবে এমন এক লক্ষ্য অর্জনের দিকে যাতে দুনিয়ায় শান্তি, ন্যায়-বিচার, সততা ও মহত্বের রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। কোন ব্যক্তি বা দল আল্লাহর বান্দাহদেরকে নিজের বান্দায় পরিণত করতে না পারে, শাসন ক্ষমতা ও সম্পূর্ন শক্তিকে আল্লাহর আমানত মনে করা হয় এবং তা ব্যবহার করা হয় আল্লাহর বান্দাদের কল্যাণে। আইনের ক্ষেত্রে সে বিবেচনা করবে, যাতে ন্যায় ও সুবিচারের সাথে মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা যায় এবং কোন প্রকারে কারুর উপর যুলুম হতে না পারে।

মুসলিম চরিত্রে থাকবে আল্লাহ ভীতি, সত্যনিষ্ঠা ও ন্যায়পরায়নতা। সবকিছুরই মালিক আল্লাহ, এ ধারণা নিয়ে সে বাস করবে দুনিয়ার বুকে। আমার ও দুনিয়ায় মানুষের দখলে যা কিছু আছে, সবই আল্লাহর দান। কোন জিনিসের এমন কি আমার নিজের দেহের ও দেহের শক্তির মালিকও আমি নিজে নই। সবকিছুই আল্লাহর আমানত এবং এ আমানত থেকে ব্যয় করবার যে স্বাধীনতা আমায় দেয়া হয়েছে, আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী তা প্রয়োগ করাই হচ্ছে আমার কর্তব্য। একদিন আল্লাহ তা’আলা আমার কাছ থেকে এ আমানত ফেরত নেবেন এবং সেদিন প্রত্যেকটি জিনিসের হিসেব দিতে হবে।

এ ধারণা নিয়ে যে ব্যক্তি দুনিয়ায় বেঁচে থাকে, তার চরিত্র সহজেই অনুমান করা যায়। কুচিন্তা থেকে সে তার মনকে মুক্ত রাখবে, মস্তিষ্ককে দুষ্কৃতির চিন্তা থেকে বাঁচিয়ে রাখবে, কানকে সংরক্ষণ করবে অসৎ আলোচনা শ্রবণ থেকে, কারোর প্রতি কুদৃষ্টি দেয়া থেকে চোখকে সংরক্ষণ করবে, জিহবাকে সংরক্ষণ করবে অসত্য উচ্চারণ থেকে। হারাম জিনিস দিয়ে পেট ভরার চেয়ে উপবাসী থাকাই হবে তার কাম্য। যুলুম করার জন্য সে কখনো তুলবে না তার হাত। সে কখনো তার পা চালাবে না অন্যায়ের পথে। মাথা কাটা গেলেও সে তার মাথা নত করবে না মিথ্যার সামনে। যুলুম ও অসত্যের পথে সে তার কোন আকাংখা ও প্রয়োজন মিটাবে না। তার ভিতর হবে সততা ও মহত্বের সমাবেশ। সত্য ও ন্যায়কে সে দুনিয়ার সবকিছুর চেয়ে অধিকতর প্রিয় মনে করবে এবং তার জন্য সে তার সকল স্বার্থ ও অন্তরের আকাংখা, এমন কি নিজস্ব সত্তাকে পর্যন্ত কুরবান করে দেবে। যুলুম ও অন্যায়কে সে ঘৃণা করবে সবচেয়ে বেশী এবং কোন ক্ষতির আশংকায় অথবা লাভের লোভে তার সমর্থন করতে অগ্রসর হবে না। দুনুয়ার সাফল্যও এ শ্রেণীর লোকই অর্জন করিতে পারে।

যার শির আল্লাহ ছাড়া আর কারুর কাছে অবনত হয় না, যার হাত আল্লাহ ছাড়া আর কারুর সামনে প্রসারিত হয় না, তার চেয়ে বেশী সম্মনের অধিকারী, তার চেয়ে বেশী সম্ভ্রান্ত আর কে হতে পারে? অপমান কি করে তার কাছে ঘেষবে?

যার দিলে আল্লাহ ছাড়া আর কারুর ভীতি স্থান পায় না, আল্লাহ ছাড়া আর কারুর কাছে সে পুরস্কারের ও ইনামের প্রত্যাশা করে না, তার চেয়ে বড় শক্তিমান আর কে? কোন শক্তি তাকে বিচ্যুত করতে পারে সত্য-ন্যায়ের পথ থেকে, কোন সম্পদ খরিদ করতে পারে তার ঈমানকে?

আরাম-পূজারী যে নয়, ইন্দ্রিয়পরতার দাসত্ব যে করে না, বল্গাহারা লোভী জীবন যার নয়, নিজ সৎ পরিশ্রম লব্ধ উপার্জনে যে খুশী, অবৈধ সম্পদের স্তুপ যার সামনে এলে সে ঘ্রীনাভরে উপেক্ষা করে, মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ শান্তি ও সন্তোষ যে লাভ করেছে, দুনিয়ায় তার চেয়ে বড় ধনী, তার চেয়ে বড় সম্পদশালী আর কে?

যে ব্যক্তি পত্যেক মানুষের অধিকার স্বীকার করে নেয়, কাউকে বঞ্চিত করে না তার ন্যায্য অধিকারে; প্রত্যেক মানুষের সাথে যে করে সদাচরণ, অসদাচরণ করে না কারুর সাথে, বরং প্রত্যেকেরই কল্যাণ প্রচেষ্টা যার কাম্য, অথচ তার প্রতিদানে সে কিছু চায় না, তার চেয়ে বড় বন্ধু ও সর্বজন প্রিয় আর কে হতে পারে? মানুষের মন আপনা থেকেই ঝুঁকে পড়ে তার দিকে, প্রত্যেকটি মানুষই বাধ্য হয় তাকে সম্মান ও প্রীতি দিয়ে কাছে টেনে নিতে।

তার চেয়ে বেশী বিশ্বস্ত দুনিয়ায় আর কেউ হতে পারে না, কারণ সে কারুর আমানত বিনষ্ট করে না, ন্যায়ের পথ থেকে মুখ ফিরায় না। প্রতিশ্রুতি পালন করে এবং আচরণের সততা প্রদর্শন করে, আর কেউ দেখুক আর না দেখুক আল্লাহ তো সবকিছুই দেখছেন, এ ধারণা নিয়ে সে সবকিছুই করে যাচ্ছে ঈমানদারীর সাথে। এমন লোকের বিশ্বস্ততা সম্পর্কে কে প্রশ্ন তুলবে, কে তার উপর ভরসা না করবে?

মুসলিম চরিত্র ভাল করে বুঝতে পারলেই বিশ্বাস করা যেতে পারে যে, দুনিয়ায় মুসলিম কখনো অপমানিত, বিজিত ও অপরের হুকুমের তাবেদার হয়ে থাকতে পারে না। সবসময়েই সে থাকবে বিজয়ী ও নেতা হয়ে, কারণ ইসলাম তার ভিতর যে গুণের জম্ম দিয়েছে তার উপর কোনো শক্তিই বিজয়ী হতে পারে না।

এমনি করে দুনিয়ায় ইজ্জত ও সম্মানের সাথে জীবন অতিবাহিত করে যখন সে তার প্রভুর সামনে হাযির হবে, তখন তার উপর বর্ষিত হবে আল্লাহর অসীম অনুগ্রহ ও রহমাত, কারণ যে আমানত আল্লাহ তার নিকট সোপর্দ করেছিলেন, সে তার পরিপূর্ণ হক আদায় করেছে এবং আল্লাহ যে পরীক্ষায় তাকে ফেলেছেন, সে কৃতিত্বের সাথে তাতে পরিপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে। এ হচ্ছে চিরন্তন সাফল্য যার ধারাবাহিক চলে আসে দুনিয়া থেকে আখেরাতের জীবন পর্যন্ত এবরং তার ধারা কখনো হারিয়ে যায় না।

এ হচ্ছে ইসলাম--মানুষের স্বাভাবধর্ম। কোন জাতি বা দেশের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ নয় এ বিধান। সকল যুগে সকল জাতির মধ্যে ও সকল দেশ যেসব আল্লাহ পরস্ত ও সত্যনিষ্ঠ মানুষ অতীত হয়ে গেছেন, তাদের ধর্ম-- তাদের আদর্শ ছিলো ইসলাম। তারা ছিলেন মুসলিম- হয়তো তাদের ভাষায় সে ধর্মের নাম ইসলাম অথবা অপর কিছু ছিলো।

আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ(সঃ)

আরবের ধূসর মরুর উষর বুকে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট [মতান্তরে ২০ আগস্ট] মতান্তরে ৫৭১ খ্রিস্টাব্দের ২০ [অথবা ২১] এপ্রিল [৯ মতান্তরে ১২ রবিউল আউয়াল] সোমবার মহাপুরুষ হযরত মোহাম্মদ (স:) মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ গোত্রের সম্ভ্রান্ত হাশিম শাখায় জন্মগ্রহণ করেন। মিশরের বিখ্যাত জ্যোতিষশাস্ত্রবিদ মাহমুদ পাশা ফালাকী গাণিতিক যুক্তিতর্কের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন যে, হযরত মোহাম্মদ (সঃ) ৫৭১ খ্রিস্টাব্দের ২০ এপ্রিল রবিউল আউয়াল মাসের ৯ তারিখ, সোমবার সুব্হে সাদিকের অব্যবহিত পরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল্লাহ এবং মাতার নাম আমিনা বিনতে আব্দুল ওয়াহাব জহরি।
মানচিত্রের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, আরবের পশ্চিমে লোহিত সাগর, পূর্ব-উত্তরে দজলা বা টাইগ্রীস নদ, পারস্য উপসাগর, ওমান উপসাগর ও আরব সাগর। দক্ষিণে ভারত মহাসাগর। উত্তরে আলেপ্পো শহর ও ফোরাত নদী। জলবায়ু চরমভাবাপন্ন। বারো মাস ঝড়ো হাওয়া বইলেও বৃষ্টিপাত হয় খুবই সামান্য। পূর্ব-পশ্চিম ও দক্ষিণে সমুদ্র বেষ্টিত হওয়া সত্বেও আরব তরুলতাহীন পর্বত ও মরুময় এক অঞ্চল। তবে মরুপ্রান্তরের মাঝে-মধ্যে স্বচ্ছ ঝর্ণাস্রোত, খেজুর আর ডালিমের সিগ্ধ মরুদ্যান মানুষের বসতির জন্য অনেকটা অনুকূল। মরুর বিভিন্ন জনপদে পশুসম্পদ বলতে ছিল উট, ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া ও গাধা। যদিও মাটির নীচে ছিল সোনাসহ নানা খনিজ দ্রব্য এবং তেল। মরু সন্তানেরা ছিল সাহসী ও যুদ্ধপ্রিয়। লুক্তনবৃত্তিকে তারা সম্মানজনক পেশা মনে করতো। আরবের সাহিত্য-সংস্কৃতি তুলনামূলক বিচারে খুব অনুজ্জ্বল ছিল না। হযরত মোহাম্মদ (স:)-এর আবির্ভাবকালে উজ্জ্বল ঐতিহ্যের আরব ভূমি অন্ধকারে ডুবে ছিল। পরাধীনতার অভিশাপ তার ইতিহাসকে কলংকিত না করলেও সামাজিক ও নৈতিক অধঃপতন চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল।
মোহাম্মদ (স:) ছিলেন মানবতার মূর্তপ্রতীক। তিনি পৃথিবীর সকল প্রান্তের এবং সকল স্তরের মানুষের কাছে কেয়ামত বা মহাপ্রলয়ের দিন পর্যন্ত অনুসরণযোগ্য সুমহান চারিত্রিক ও মানবিক গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে চল্লিশ বছর বয়সে তিনি নবুয়ত লাভ করেন। ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি মদীনায় হিজরত করেন। ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রা:)-এর শাসনামলে তাঁর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের দিনকে ইসলামী বর্ষপঞ্জির সূচনা ধরে হিজরী সন প্রবর্তন করেন। অল্প সময়ের মধ্যে ধর্ম হিসেবে ইসলাম আরবের বিপুল জনগোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে এবং একইসঙ্গে নবী হিসেবে তিনি সকলের কাছে সুমহান মর্যাদায় সমাসীন হন। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারী তিনি তাঁর অনুসারী-অনুগামীদের নিয়ে শেষ হজ্বব্রত পালন করতে মক্কায় রওয়ানা হন এবং ৭ মার্চ মক্কায় পৌঁছান এবং ৮ মার্চ [৯ই জিলহজ্জ] বিদায় হজ্বের ভাষণ দেন। এর তিন মাস পর তিনি ইন্তেকাল করেন।
মোহাম্মদ (স:) নামের অর্থ চরম প্রশংসাকারী। সমগ্র পৃথিবীতে যে সকল বিখ্যাত ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁদের মধ্যে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ। লোহিত বর্ণের বালুকারাশিতে পূর্ণ আরবের দুর্গম মরু অঞ্চলে এ পর্যন্ত যত রাজা-বাদশাহ, কবি-দার্শনিক জন্মেছেন, মোহাম্মদ (স:) সকল দিক থেকেই তাদের সবাইকে অতিক্রম করে গেছেন। তিনি ছিলেন নেতাদের নেতা, রাজাদের রাজা, দার্শনিকদের দার্শনিক। মোহাম্মদ (স:) তাঁর চারিত্রিক মাধুর্যে, দৃঢ় সংকল্পে আর আপন মহত্ত্বে আরব জাহানকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দেন। তাঁর বদৌলতেই আরবে নবজীবন সঞ্চারিত হয়, নতুন সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটে, নবীন সভ্যতার গোড়াপত্তন হয় এবং উদ্ভব ঘটে একটি নতুন জীবন ব্যবস্থার। অচিরেই এই সভ্যতার আলো ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা থেকে মরক্কো হয়ে ভারতবর্ষের দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। তাছাড়া হযরত মোহাম্মদ (স:)-এর সাম্য ও স্বাধীনতার আদর্শ এবং মানব কল্যাণের চিন্তা-চেতনা এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশের চিন্তা ও জীবনধারাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
ইতিহাসের অন্যতম প্রধান ও প্রভাবশালী ধর্মীয় এবং সামরিক নেতা মহানবী হযরত মোহাম্মদ (স:) জন্মের ছয়মাস আগেই পিতৃহীন হন। পিতৃহীন এই সন্তানের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পড়ে তাঁরই পিতামহ ও সম্ভ্রান্ত হাশেম গোত্রের তদানীন্তন প্রধান আবদুল মুত্তালিবের উপর। তিনি তাঁর প্রতিপালনের জন্য সা’দ বংশের হালিমা নামের এক বেদুইন মহিলাকে অর্থের বিনিময়ে দুধ পান করানোর ব্যবস্থা করে দেন। ছয় বছর পর দুধমাতা হালিমা তাঁকে তাঁর মা আমিনার কাছে ফেরত পাঠানোর পর তিনি তাঁর স্বামীর কবর জিয়ারত করার উদ্দেশ্যে শিশুপুত্র মোহাম্মদ ও পরিচারিকা উম্মে আইমানকে সঙ্গে নিয়ে মক্কা থেকে তিনশত মাইল পূর্বে মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তারা মদীনায় পৌঁছে সেখানে একমাস অবস্থান করেছিলেন। মায়ের সঙ্গে মদীনায় অবস্থানের স্মৃতি তাঁর স্মরণে ছিল। মদীনা থেকে মক্কা অভিমুখে অর্ধেকটা পথ অতিক্রম করার পর ‘আবওয়া’ নামক একটি গ্রামে হঠাৎ তাঁর আম্মাজান অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অপ্রতাশিতভাবে মৃত্যুবরণ করেন। সেখানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। উম্মে আইমান মাতৃ-পিতৃহীন শিশু মোহাম্মদকে মক্কায় তাঁর পিতৃব্য আবদুল মুত্তালিবের কাছে বুঝিয়ে দেন। মক্কার কুরাইশদের সঙ্গে মুসলমানদের হোদাইবিয়ার সমঝোতা চুক্তি হওয়ার পর মক্কা থেকে মদীনা প্রত্যাবর্তন করার পথে আবওয়া গ্রামে রসুল তাঁর মায়ের কবর জিয়ারত করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন।
তাঁর পিতৃব্য ইন্তেকাল করলে তাঁকে লালন-পালন করেন চাচা আবু তালিব। বালক মোহাম্মদের বয়স যখন ১২ বছর তখন তাঁর চাচা আবু তালিব ব্যবসায়ের কাজে রওয়ানা হলে বালক মোহাম্মদ তাকেও সঙ্গে নেবার জন্য অনুনয়-বিনয় শুরু করেন। দুর্গম মরু যাত্রায় কষ্টের কথা ভেবে তিনি তাকে সঙ্গে নিতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু ভ্রাতুষ্পুত্র মোহাম্মদ উটের লাগাম ধরে এই বলে কাঁদতে শুরু করলেন যে, ‘আমার না আছে বাবা, না আছে মা, আমাকে একা ফেলে আপনিও চলে যাচ্ছেন, আমাকেও আপনার সঙ্গে নিয়ে যান।’ বালকের এ কাতর আবেদনকে উপেক্ষা করা তাঁর পক্ষে আর সম্ভব হলো না। তিনি শাম (সিরিয়া) দেশের দিকে বাণিজ্য করতে যাচ্ছিলেন। এ যাত্রায় বালক মোহাম্মদকেও তিনি সঙ্গে নিতে বাধ্য হন। এভাবেই বৃহত্তর বিশ্বের সঙ্গে তাঁর পরিচয় লাভের সুযোগ ঘটে এবং মোহাম্মদ (সঃ)-এর জীবনে নতুন অধ্যায় শুরু হয়।
আরবের বিখ্যাত ওকাজ মেলাতেই গোত্র বিরোধ থেকে ফেজার যুদ্ধ সংগঠিত হয়। সকল গোত্র ও গোষ্ঠী এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এই যুদ্ধে তরুণ মোহাম্মদও তাঁর পিতৃব্যদের সঙ্গী ছিলেন। দীর্ঘস্থায়ী গোত্রযুদ্ধের ফলে মক্কায় ইয়াতিম, বিধবা এবং নিঃসহায় মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। হত্যা, লুঠতরাজ অভ্যাসে পরিণত হতে থাকে। দুর্বলের ওপর নিপীড়ন ও নির্যাতনের দৌরাত্ম চলতে থাকে। অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য জনআকাঙক্ষাও বাড়তে থাকে। ফুজজার যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন করার পর মোহাম্মদ (সঃ)-এর কনিষ্ঠ পিতৃব্য জুবাইর ইবনে আবদুল মোত্তালিবের প্রস্তাবক্রমে বনু হাশিম, বনু যুহরা ও বনু নাঈম ইত্যাদি গোত্রের লোকজন মক্কার অন্যতম সৎ ও দানশীল ব্যক্তি আবদুল্লাহ ইবনে জা’দআনের গৃহে সমবেত হয়ে একটি চুক্তিপত্র সম্পাদন করেন এবং ‘হিলফুল ফুজুল’ নামের একটি সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। অসহায় ও দুর্গত মানুষকে সাহায্য করার অঙ্গীকার নিয়ে গঠিত এই সংগঠনটি। হতাশার ঘোর অন্ধকারের মধ্যে কিঞ্চিত আশার আলো সঞ্চার করেছিল। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এই সমাজ সেবামূলক সমিতির সাংগঠনিক তৎপরতায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। উৎপীড়িত ও অত্যাচারিতকে সাহায্য করার অঙ্গীকারের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন বলেই খাদ্যের অভাবে ক্রন্দনরত অনাথের দুঃখ মোচনে, বিধবা নারীর কান্না থামাতে এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তিনি তৎপর হয়েছিলেন। আর্থ-সামাজিক সমস্যার প্রতিকার চিন্তায় তাঁর সততা, আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততা সবার শ্রদ্ধা কেড়েছিলো। তিনি সত্যবাদী, শান্তিপ্রিয় এবং পরম বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসেবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিলেন। এই গুণাবলী এবং ভাবমূর্তি পরবর্তীকালে তাঁকে ব্যবসায়ী জীবনে অভাবিত সাফল্য এনে দিয়েছিল। প্রতিশ্রুতি রক্ষায় তাঁর খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। মক্কার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী খাদিজার বাণিজ্য কাফেলার প্রধান পদে নিয়োগ লাভের জন্য তাঁর এই বিশ্বস্ত ভাবমূর্তি বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। বাণিজ্যিক কাজে তাঁর দক্ষতা ও আর্থিক লেন-দেনের ক্ষেত্রে তাঁর স্বচ্ছতা ধনাঢ্য ও বিদুষী রমনী খাদিজাকে মুগ্ধ করেছিল।
নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বেই মক্কার সমাজে তাকে ‘আল আমীন’ এবং ‘আস-সাদিক’ বলা হতো। চাচা আবু তালিবের অনুরোধে মক্কার ধনাঢ্য বিধবা মহিলা খাদিজা বিনতে খোয়াইলিদ তাঁকে ব্যবসার কাজে নিয়োগ করেন এবং বাণিজ্য কাফেলার সঙ্গে সিরিয়া পাঠান। ঐ বছর ব্যবসায় খাদিজার প্রচুর লাভ হয়। পঁচিশ বছর বয়সে মোহাম্মদ (স:) তাঁর চেয়ে পনেরো বছরের বড় এই বিধবা মহিলা খাদিজাকে বিয়ে করেন এবং তাঁর সঙ্গে হযরত মোহাম্মদ (স:) পঁচিশ বছর সংসার জীবন যাপন করেন। তাঁদের দাম্পত্য জীবন অত্যন্ত মধুর ছিল। তার গর্ভে তিন পুত্র-কাসেম, তাইয়েব ও তাহের এবং চার কন্যা- জয়নব, রুকাইয়া, কুলসুম ও ফাতেমা জন্মলাভ করেন। শৈশবেই তিন পুত্রের মৃত্যু হয়। জ্যেষ্ঠা কন্যা জয়নবের বিয়ে হয় আবুল আসের সঙ্গে। রুকাইয়ার বিয়ে হয় হযরত উসমান (রা:)-এর সঙ্গে এবং রুকাইয়ার মৃত্যুর পর তিনি কুলসুমকে বিয়ে করেন। সর্বকনিষ্ঠা ফাতেমার বিয়ে হয় হযরত আলী (রা:)-এর সঙ্গে। পরবর্তীকালে তাঁর স্ত্রী মারিয়া কিবতিয়ার গর্ভে ইব্রাহীম নামে আরও একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেন। তিনিও কিশোর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
খাদিজাসহ আল্লাহর রসুল (স:) যে সকল নারীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তাদের মোট সংখ্যা ১১, মতান্তরে ১৩। খাদিজা (রা:)-এর জীবদ্দশায় তিনি অন্য কোন নারীর সংগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননি। তাঁর সহধর্মীনীদের মধ্যে একমাত্র হযরত আবু বকর (রা:)-এর কন্যা আয়েশা (রা:) ছিলেন কুমারী। হযরত খাদিজা (রা:) এবং হযরত জয়নব (রা:) তাঁর জীবদ্দশায় মারা যান। অপর নয়জন মতান্তরে এগার জন তাঁর মৃত্যুকালে জীবিত ছিলেন।
তাঁর বয়স যখন ৩৫ বছর তখন আগুন লেগে কাবা ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোরাইশরা কাবা পুনঃনির্মাণ করেন। কিন্তু হজরে আসওয়াদটি যথাস্থানে বসানো নিয়ে শুরু হয় বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে মর্যাদার লড়াই। হযরত মোহাম্মদ (স:) একটি চাদর বিছিয়ে তার উপর নিজ হাতে হজরে আসওয়াদ রেখে সকল গোত্রের লোককে চাদর ধরে উপরে উঠাতে বলেন। পরে তিনি নিজ হাতে পাথরটিকে যথাস্থানে বসিয়ে দেন। সবাই তাঁর এই উপস্থিতবুদ্ধি দেখে চমৎকৃত হন।
তাঁর বয়স যখন ৪০-এর কাছাকাছি তখন তিনি নির্জনতা ভালবেসে মক্কার উত্তরে অবস্থিত হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকা শুরু করেন। খাড়া এই পর্বতটির উচ্চতা ২০০ মিটার। এই পর্বতের গুহায় বসে তিনি মক্কা নগরীর নৈতিক ও সামাজিক অধঃপতন নিয়ে গভীর চিন্তায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন। ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে একদিন হেরা পর্বতে ধ্যানমগ্ন থাকা অবস্থায় তিনি আচমকা এক গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে হতচকিত হয়ে পড়েন। তাকে বলা হয়-‘পড়ো, তোমার প্রভুর নামে- যিনি সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা এবং ঘণীভূত শোনিত হতে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। পড়ো, তোমার মহিমান্বিত প্রভুর নামে, যিনি লিখতে শিখিয়েছেন এবং শিক্ষা দিয়েছেন এমন বিষয়াদি-যা তার জানা ছিলো না’। (কোরআন-৯৬: ১-৫)
এই ঘটনায় নিজের ক্ষতির আশঙ্কায় তিনি বিচলিতবোধ করতে থাকেন। কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফিরে এসে তিনি স্ত্রী খাদিজাকে তাঁর দেহ কম্বল দ্বারা আবৃত করে দিতে বলেন। তিনি তাকে সান্ত¡না দেন এবং তাকে তাঁর চাচাতো ভাই ইহুদিপণ্ডিত ওয়ারাকা বিন নওফেলের কাছে নিয়ে যান। বিচক্ষণ এই মনীষী ঘটনার বিবরণ শুনে হযরত মোহাম্মদ (সা:)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেন। হযরত মুসা (আ:)-এর কাছে যে ফেরেশতার আগমন ঘটেছিল মোহাম্মদ (স:)-এর কাছেও সেই জিব্রাইল (আ:)-এর আগমণ ঘটেছে বলে তিনি জানান। সহধর্মীনী খাদিজা (রা:)-ই প্রথম হযরত মোহাম্মদ (স:)কে আল্লাহর রসুল বলে স্বীকার করে নেন।
ইসলাম ধর্মের মূল কথা হচ্ছে: একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কোন কিছুই পূজা-অর্চনা পাবার যোগ্য নয় এবং হযরত মোহাম্মদ (স:) এই শাশ্বত সত্যের বাহক। প্রথম তিন বছর গোপনে এরপর প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্য তিনি আদিষ্ট হন। এই সময়ে তিনি প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে পড়েন। যারা তাঁর নতুন ধর্মমতে দীক্ষা নেন তাদের ওপর নেমে আসে নির্যাতন ও জুলুম। তবে তাঁর চাচা হযরত হামজাহ এবং ওমর বিন খাত্তাব ইসলাম গ্রহণ করলে পরিস্থিতি নবীন ধর্মের অনুসারীদের জন্য কিছুটা সহনীয় হয়ে আসে। এক পর্যায়ে কোরাইশগণ লোভ ও প্রলোভন দেখিয়ে নবধর্ম ইসলামের বিস্তার ঠেকানোর চেষ্টা করে। হযরত মোহাম্মদ (স:) পরিষ্কার ভাষায় বলে দেন যে, “আমার এক হাতে চাঁদ আর অন্য হাতে সূর্য এনে দিলেও সত্য প্রচার থেকে আমি বিরত হবো না।”
আদর্শের প্রশ্নে অবিচল থাকায় তাঁকে হত্যা করার চক্রান্ত শুরু হয়। এক পর্যায়ে বনু হাশেম এবং বনু মুত্তালিব গোত্র ঐক্যবদ্ধভাবে নবী মোহাম্মদ (স:)কে রক্ষার জন্য সংকল্পবদ্ধ হলে অন্যান্য গোত্রের লোকেরা বুঝতে পারে যে, মোহাম্মদ (স:)কে হত্যা করতে গেলে মক্কায় রক্তের স্রোত বয়ে যাবে। তাই তারা হত্যার পরিকল্পনা সাময়িকভাবে স্থগিত রেখে নির্যাতনের নতুন পন্থা উদ্ভাবন করে। তারা একত্র হয়ে বনু হাশেম ও বনু মুত্তালিব গোত্রের লোকদের অবরুদ্ধ করে রাখার অনুকূলে এক লিখিত চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। চুক্তিপত্রটি লিখেছিলেন বুগাইজ ইবনে আমের ইবনে হাশেম। চুক্তি অনুযায়ী আবু লাহাব ব্যতীত বনু হাশেম ও বনু মুত্তালিবের নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, শিশু-কিশোর, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকলকে শি’বে আবু তালিব নামক ঘাঁটিতে অবরুদ্ধ রাখা হয়। হযরত মোহম্মদ (স:)-এর নবুয়ত লাভের সপ্তম বছরে এই ঘটনা ঘটে এবং তিন বছর যাবৎ অবরুদ্ধ নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধরা অমানবিক জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়।
নবুওয়ত লাভের দশম বছরে তাঁর চাচা এবং শক্তিশালী অভিভাবক আবু তালিব এবং এর পাঁচ সপ্তাহ পরে জীবনসঙ্গিনী হযরত খাদিজা (রাঃ) ইন্তেকাল করেন। এই সময়ে তিনি নিজেকে কিছুটা অসহায় মনে করতে থাকেন। তিনি মক্কা থেকে ৭০ মাইল দক্ষিণে তায়েফ গমন করেন। কিন্তু তায়েফের লোকেরা তাঁকে উপহাস ও লাঞ্ছিত করে। তাঁর পেছনে গুণ্ডাদের লেলিয়ে দেয়া হয়, যারা পাথর মেরে তাঁর পবিত্র দেহকে রক্তাক্ত করে দেয়। তারপরও তিনি হাত তুলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেন : “হে আল্লাহ, তুমি পরম দয়ালু ও সর্বশক্তিমান। অবিশ্বাসীরা না বুঝে আমার ওপর আক্রমণ চালিয়ে যে অপরাধ করেছে, আমি তাদের জন্য তোমার কাছে করুণা ভিক্ষা করছি। তোমার নিরাপত্তাই আমার জন্য যথেষ্ট। তুমি দয়া করে তাদেরকে ক্ষমা করে দাও। তাদেরকে শাস্তি দিও না। তুমি আমাদের ত্যাগ করো না এবং কখনো শত্রুদের হাতে তুলে দিও না। অবিশ্বাসীরা যে তোমার বাণী গ্রহণ করছে না এজন্য তাদের কোন দোষ নেই, দায়ী আমার দুর্বলতা, আমার অক্ষমতা। হে রহমানুর রহিম, একমাত্র তুমিই দুর্বলের বল, তুমি ছাড়া আমার আর কোন সাহায্যকারী নেই। তুমি আমাকে সাহায্য কর। আমাকে জয়যুক্ত কর। একমাত্র তোমার সন্তুষ্টিই আমার কাম্য। তুমি সন্তুষ্ট থাকলে আমি দুনিয়ার কাউকে ভয় করি না। তুমি আমার উপর রুষ্ঠ হয়ো না। যারা আমার ওপর শত্রুতা করছে, অনুগ্রহ করে তাদেরকে সৎ পথে চালিত কর। তারা জানে না তারা কি করছে। তুমি দ্বীন-দুনিয়ার মালিক, আশ্রয়হীনের আশ্রয়দাতা, নিঃসহায়ের সহায়।” আল্লাহর রসুলের দোয়া শেষ হলে ওহী নাজিল হয় ঃ ধৈর্য ধরুন, চরম ধৈর্য। নিশ্চয়ই তারা দেখছে বিজয় সুদূরপরাহত কিন্তু আমরা দেখছি বিজয় নিকটবর্তী। (সুরা ৭০, আয়াত ৫-৭)
তাঁর এই করুণ আবেদনে সাড়া দিয়ে ফেরেশতারা তায়েফবাসীকে সমুচিত শিক্ষা দিতে চাইলে তিনি তাদের অকল্যাণ কামনা থেকে বিরত থাকেন এবং এই মর্মে আশা প্রকাশ করেন যে, প্রত্যাখ্যানকারীদের বংশে এমন মানুষ জন্ম নেবে যারা শুধু আল্লাহরই বন্দেগী করবে, কাউকে তাঁর শরীক করবে না। এই সহিষ্ণু ও ক্ষমাসুন্দর মনোভাব, দুরদর্শিতা ও বিচক্ষণতা স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তাঁকে সাফল্যের সুউচ্চ শিখরে পৌঁছে দিতে মূল্যবান ভূমিকা রাখে।
তায়েফে ইসলাম প্রচারে ব্যর্থ হয়ে আল্লাহর রসুল শত্রুপুরী মক্কায় প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হন। কিন্তু ৬০ মাইল পথ অতিক্রম করার পর মক্কার অদূরে নাখলা নামক স্থানে এসে তিনি তাঁর সঙ্গী জায়েদকে মক্কার অন্যতম শক্তিমান নেতা মোতায়েম ইবনে আদির নিকট সাহায্য ও আশ্রয় প্রার্থনা করার জন্য প্রেরণ করেন। মানবতার খাতিরে তিনি সাহায্য ও আশ্রয় দান করতে সম্মত হন। আল্লাহর রসুল (স:) মক্কায় পৌঁছে মোতায়েমের গৃহে আশ্রয় নেন। মানবতাবাদী মোতায়েম নিজে, তার পুত্রদের এবং স্বগোত্রের লোকদের সঙ্গে হযরত মোহাম্মদ (স:)কে নিয়ে কাবা প্রাঙ্গনে গিয়ে কোরাইশদের উদ্দেশে বলেন, “শোন, আমি মোহাম্মদকে অভয় ও আশ্রয় দিয়েছি। অতএব সাবধান, তোমরা তাকে কিছু বলো না।” এই মোতায়েমই কোরাইশদের প্রতিজ্ঞাপত্র ছিঁড়ে ফেলে শি’বে আবু তালিব গিরি সংকট হতে হযরত মোহাম্মদ (সঃ) ও তাঁর সঙ্গীদের উদ্ধার করার মানবিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
এই পর্যায়ে আল্লাহর রসুল প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার হতে বিরত থাকেন। নবুওয়তের দশম বছর ৬২০ খ্রিষ্টাব্দে রজব মাসে তিনি মক্কার অদূরে আল-আকাবা নামক একটি পার্বত্য উপত্যকায় যান। সেখানে হজ্ব এবং ব্যবসা করতে আসা ইয়াসরিবের খাজরাজ গোত্রের ৬ জন লোকের সঙ্গে তাঁর আলাপ-আলোচনা হয়। তারা ইসলাম কবুল করেন। পরের বছর খাজরাজ গোত্রের দশজন এবং আউস গোত্রের দুইজন- এই বারো জন ইয়াসরিব হতে মক্কায় এসে আকাবায় ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন এবং ইসলামের জন্য আজীবন সংগ্রাম করার শপথ গ্রহণ করেন। যা আকাবার প্রথম শপথ হিসেবে পরিচিত। তারা ইয়াসরিবে ইসলাম প্রচার করার জন্য আল্লাহর রসুলের পক্ষ হতে একজন প্রতিনিধি পাঠানোর আবেদন জানালে তিনি মোসয়াব ইবনে ওমায়েরকে তাদের সঙ্গে পাঠান।
আকাবার প্রথম শপথের পরের বছর হজ্ব উপলক্ষে ইয়াসরিবের বিভিন্ন গোত্রের ৭৩ জন পুরুষ ও ২ জন নারী আকাবার উপত্যকায় এসে পৌঁছান। এই সংবাদে আল্লাহর রসুল উৎসাহিত ও উৎফুল্লবোধ করেন। ১২ জিলহজ্ব তারিখে তিনি চাচা আব্বাসকে সঙ্গে নিয়ে গভীর রাতে আকাবার নির্জন পর্বতের পাদদেশে ইয়াসরিব থেকে আগত নর-নারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং আলাপ-আলোচনার পর তারা সকলে ইসলাম গ্রহণ করেন। আল্লাহর রসুল তাদেরকে প্রাণপণে আল্লাহর পবিত্র কালামকে রক্ষা করার এবং সত্য প্রচারে তাঁকে সাহায্য করার আবেদন জানালে নওমুসলিমগণ একবাক্যে ঘোষণা করেন: “জীবনে-মরণে আমরা আপনার সঙ্গী হয়ে থাকবো। যতই বাধা-বিপদ আসুক না কেন আমরা তা মোকাবেলা করবো। আল্লাহর জন্য, আপনার জন্য, সত্যের জন্য, ইসলামের জন্য আমরা জান-মাল কোরবান করবো। শুধু কোরাইশদের সঙ্গে নয়, দুনিয়ার যে কোন শক্তির সঙ্গে আমরা সত্যের জন্য যুদ্ধ করবো।” এটাই ছিল আকাবার দ্বিতীয় শপথ। হযরত মোহাম্মদ (স:) সকলকে উপদেশ দানের পর প্রতিনিধি দলের মধ্য থেকে ১২ জন লোককে নির্ধারণ করে দিতে বললেন যারা ইসলাম প্রচার করবেন। সঙ্গে সঙ্গে আউস ও খাজরাজ গোত্র হতে ১২ জন লোককে তারা নির্বাচিত করে দিলেন। নওমুসলিমগণ তাদের সঙ্গে আল্লাহর রসুলকে ইয়াসরিব যাওয়ার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করলেন। এই আমন্ত্রণ পাবার পর তিনি বললেন, “মক্কায় যারা ইসলাম কবুল করেছেন তাদেরকে ফেলে আমি আগে ইয়াসরিব যেতে পারি না। প্রথমে তাদের ব্যবস্থা করতে হবে।” ইয়াসরিব থেকে আগত এই প্রতিনিধি দলে ইতিপূর্বে প্রেরিত আল্লাহর রসুলের প্রতিনিধি মুসয়াবও ছিলেন। তিনিও হযরত মোহাম্মদ (সঃ)কে ইয়াসরিবে দ্রুত ইসলামের প্রসার লাভের কথা জানালেন। আল্লাহর রসুলের মন ইয়াসরিব গমনের জন্য উন্মুখ হয়ে রইল।
নবুয়ত লাভের দশম বছরে চরম দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও ইসলামের প্রসার এবং আল্লাহর রসুলের আধ্যাত্মিকতার উচ্চমার্গে উত্তরণ ঘটেছিল। তাঁর বয়স যখন পঞ্চাশ তখন একদিন তিনি মক্কাতে শি’বে আবু তালিবে অবস্থিত আবু তালিবের কন্যা উম্মে হানির বাড়ীতে এশার নামাজ পড়ে নিদ্রিত ছিলেন তখন তাঁর একপাশে নিদ্রিত ছিলেন চাচা হামজা, অন্যপাশে ঘুমাচ্ছিলেন তাঁর চাচাতো ভাই জাফর (রা:)। রাত্রি যখন দ্বিপ্রহর তখন হযরত জিব্রাইল (আ:) তাঁর নাম ধরে ডাক দিলেন এবং তাঁকে বোরাক নামের স্বর্গীয় বাহনে করে প্রথমে জেরুজালেমস্থিত হযরত সুলায়মান (আ:) নির্মিত বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদে নিয়ে যান।
তারপর একে একে জিব্রাইল (আ:) তাঁকে নিয়ে সপ্তম আসমানে সিদরাতুল মুনতাহায় গিয়ে হাজির হন। এরপর আল্লাহর রসুলকে একাকী বায়তুল মামুর পর্যন্ত যেতে হয়। অপূর্ব জ্যোতিস্নিগ্ধ মনোরম এ স্থানে তিনি মহান আল্লাহর স্বরূপ প্রত্যক্ষ করেন। পর্দার আড়াল থেকে উভয়ের মধ্যে সংলাপ হয়। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক করার আদেশপ্রাপ্ত হন তিনি। মেরাজ সম্পর্কে কোরআনের ভাষ্য হচ্ছে: “তাঁরই মহিমা, যিনি তাঁর দাসকে এক রজনীতে পবিত্র মসজিদ (কাবা ঘর) হতে দূরতম মসজিদ (আল-আকসা) পর্যন্ত পরিভ্রমণ করিয়েছিলেন।” (আল-কোরআন, সূরা ১৭, আয়াত-১)
কোরআন মজীদে এ প্রসঙ্গে আরও বলা হয়েছে, “তিনি ক্রমশ আল্লাহর নিকটবর্তী হলেন। দু’টি ধনুকের জ্যার মধ্যে যতটুকু ব্যবধান তিনি তার চেয়েও কম দূরবর্তী ছিলেন। অতঃপর আল্লাহ তাঁর দাস মোহাম্মদ (স:) কে যা প্রত্যাদেশ করার তা করলেন।” (আল কোরআন, সূরা ৫৩, আয়াত ৭-১০)
শর্তসমূহ মুসলমানদের জন্য অসম এবং বিব্রতকর হলেও হুদাইবিয়ার চুক্তি সম্পাদনের পর মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোরাইশদের যুদ্ধংদেহী মনোভাবে ভাটা পড়ে। তাদের কঠোর ও কঠিন প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। মূর্তি পূজায় উৎসাহ-উদ্দীপনাও হ্রাস পায়। এই সন্ধি, উদীয়মান মুসলিম শক্তির মক্কা বিজয়ে বিরাট ভূমিকা রাখে। তাঁর সাহস, ধৈর্য এবং বিচক্ষণতা তখনকার মানুষকে যেমন মুগ্ধ করে তেমনি অনাগত মানুষদের জন্যও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকে। সৃষ্টি জগতের জন্য তিনি যে রহমতস্বরূপ ছিলেন বিভিন্ন ঘটনায় তা প্রমাণিত হতে থাকে। তাঁর চরিত্রের কমনীয়তা ও দৃঢ়তা, সকল গোঁড়ামী ও হঠকারিতার উপর শেষপর্যন্ত বিজয় অর্জন করতে থাকে।
অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর শত্রুর কাছ থেকে সহানুভূতি পাবার আশায় বিনয় ও বশ্যতা অবলম্বনের নীতি নবী করিম (স:)কে কখনো অনুসরণ করতে দেখা যায়নি। তিনি ছিলেন সরল ও অকপট। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁকে কখনো মিথ্যার আশ্রয় নিতেও দেখা যায়নি। নীতির প্রশ্নে তাকে সব সময় সুদৃঢ় অবস্থান নিতে দেখা গেছে। তবে নীতি বাস্তবায়নে তাঁর কৌশল ছিল অত্যন্ত স্থিতিস্থাপক। তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং নেতৃত্ব সহকর্মীদের মুগ্ধ করেছে। তিনি সর্বদা আল্লাহর ওপর নির্ভর করেছেন, সবার জন্য তিনি আল্লাহর ভালোবাসা ও ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। তাঁর দয়া ও মহানুভবতা দেখে বিরোধী পক্ষ পর্যন্ত অভিভূত হয়েছে।
আল্লাহর রসুল হযরত মোহাম্মদ (সঃ)-এর মক্কা বিজয় মানব ইতিহাসের এক চমকপ্রদ অধ্যায়। হোদাইবিয়ার সন্ধির শর্তাবলী একের পর এক কোরাইশগণ লংঘন করতে থাকলে হযরত মোহাম্মদ (স:) ইবনে উম্মে মাকতুমকে মতান্তরে আবুজর গিফারীকে মদীনায় তাঁর প্রতিনিধি নিযুক্ত করে ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে দশ মতান্তরে বারো হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। মক্কার অদূরে ‘মাররাজ’ নামক স্থানে তিনি শিবির স্থাপন করেন। এই সংবাদ পেয়ে কোরাইশদের প্রধান নেতা আবু সুফিয়ান দুইজন সঙ্গী নিয়ে মুসলিম শিবিরে গোপনে ঢুকে পড়ে। হযরত ওমর ফারুক রক্ষীসহ ছদ্মবেশে চারদিক পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তাঁর হাতেই আবু সুফিয়ান ও তাঁর দু’জন সঙ্গী বন্দী হন। তাদেরকে আল্লাহর রসুলের কাছে হাজির করা হয়। সকলের ধারণা ছিল যে ইসলামের এই ঘোর দুশমনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে আল্লাহর রসুল তাকে ক্ষমা করে দেন। ইসলামের আদর্শ ও হযরত মোহাম্মদ (স:)-এর মহত্ত্বে আবু সুফিয়ান অভিভূত হন। আল্লাহর রসুল তাকে জিজ্ঞেস করেন, “ভুল ভাঙ্গতে আর কতদিন লাগবে?” আবু সুফিয়ান বলেন, “দেব-দেবীর পুজা করি, ভক্তি করি, আজ আমি বন্দী, সাহায্য চেয়ে কোন সাড়া পেলাম না। কি করে আর তাদের সত্য বলি।”
আল্লাহর রসুল বললেন, তবে অকুণ্ঠ চিত্তে বলুন, “আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং মোহাম্মদ এই সত্যের বাহক।” আবু সুফিয়ান বলে উঠলেন: “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।” আল্লাহর রসুল আবু সুফিয়ানকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। যিনি ছিলেন শত্রু তিনি হলেন মিত্র। মক্কা বিজয়ের ইতিহাস এভাবেই সূচিত হয়। আবু সুফিয়ান মক্কায় ফিরে গিয়ে বললেন, “আমি এখন আর কোরাইশদের নেতা নই। আমি এখন মুসলমান। মোহাম্মদ দশ হাজার সৈন্য নিয়ে আমাদের দ্বারে উপস্থিত। যদি ভাল চাও তো কাবাগৃহে, আমার গৃহে অথবা নিজ নিজ গৃহে অবস্থান করো, তবেই রক্ষা পাবে।
প্রত্যুষে আল্লাহর রসুল মক্কা নগরীতে প্রবেশের আয়োজন করলেন। বিভিন্ন দলপতিকে মক্কার বিভিন্ন রাস্তায় প্রবেশের আদেশ প্রদানকালে এই বলে সতর্ক করে দিলেন যে, “সাবধান, কাউকে আক্রমণ করো না। কেউ আক্রমন করলে আত্মরক্ষা করবে।” প্রথমে মহাবীর খালিদ ঝাণ্ডা উড়িয়ে পাঁচশত সৈন্যের একটি দল নিয়ে কুচকাওয়াজ করে অগ্রসর হলেন। আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হলো। সবার শেষে আল্লাহর রসুল তাঁর ‘কাসওয়া’ নামক উটে আরোহন করে পাঁচ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলেন। কোরাইশদের পক্ষে ইকরামা বিন আবু জহল, মাফওয়া বিন উমাইর প্রমুখ প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিল কিন্তু মহাবীর খালিদ বিন ওয়ালিদের দল তাদের প্রতিরোধ সহজেই চূর্ণ করে দিতে সক্ষম হন। কার্যত বিনা যুদ্ধে, বিনা রক্তপাতে, বিনা ধ্বংসে মক্কা জয় করেন আল্লাহর রসুল। কোরআনের বাণী-নাজিল হয়: “সত্য এসেছে এবং মিথ্যা দূরিভূত হয়েছে, মিথ্যা নিশ্চয়ই প্রত্যাখ্যাত হবে।” [আল কোরআন, সুরা ১৭ আয়াত ৮১]
সমবেত অপরাধীদের উদ্দেশে আল্লাহর রসুল ঘোষণা করলেন, “তোমাদের বিরুদ্ধে আজ আমার কোন অভিযোগ নেই। তোমাদের সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে দিলাম। আল্লাহও তোমাদের ক্ষমা করুণ এবং তোমাদের উপর অনুগ্রহ করুন”। (সুরা ইউসুফ আয়াত ৯২)। যাদের প্রাণদন্ড অবধারিত বলে ধারণা করা হয়েছিল তাদের অপরাধও তিনি ক্ষমা করে দিলেন। ভীত বিহবল একজন লোককে কাঁপতে কাঁপতে আসতে দেখে আল্লাহর রসুল তাকে বললেন, “তুমি কাঁপছো কেন? ভয় পাচ্ছ কেন? আমি তো রাজা বাদশাহ নই- আমি আল্লাহর রসুল।”
৬৩২ খ্রিস্টাব্দে তথা ১০ম হিজরীর ৯ই জিলহজ্ব আল্লাহর রসুল বিদায় হজ্ব উপলক্ষে আরাফাতের ময়দানে এক গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণী ভাষণ দেন। তাঁর সেই ভাষণ নকীবদের মাধ্যমে লক্ষাধিক মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়। পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার মহিমা বর্ণনা এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পর হযরত মুহাম্মদ (স:) বলেন, হে জনমণ্ডলী! অন্ধকার যুগের সমস্ত কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস এবং সকল প্রকার অনাচার পদদলিত, রহিত ও আজ থেকে বাতিল হয়ে গেল। জাহেলী যুগের সমস্ত হত্যা ও খুনের প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার বাতিল করা হল এবং আমি সর্বপ্রথম এ বিষয়ে আমার নিজ গোত্রের রাবী‘আ ইবনে হারিসের পুত্রের খুনের প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার বাতিল ঘোষণা করলাম। জাহেলী যুগের সমস্ত সুদ বাতিল করা হল। আর আমি সর্বপ্রথম আমার চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের সুদ বাতিল করে দিলাম।
হে লোক সকল! তোমরা শুনে রাখো, আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেককেই তার যথাযথ অধিকার দিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং উত্তরাধিকারীর জন্য কোনরূপ ওসীয়াত কার্যকর হবে না।
তিনি একজনের অপরাধের জন্য আরেক জনকে দণ্ড দানের বিধান রহিত করে দিয়ে বলেন, অতঃপর পিতার অপরাধের জন্য পুত্র এবং পুত্রের অপরাধের জন্য পিতাকে দায়ী করা চলবে না। কোন কাফ্রি ক্রীতদাসকেও যদি তোমাদের আমীর করে দেয়া হয় এবং সে যদি আল্লাহর বিধান মোতাবেক তোমাদেরকে পরিচালনা করেন তবে তোমরা তাঁর আনুগত্য করবে এবং তার আদেশ মেনে চলবে। সাবধান! ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না, এই বাড়াবাড়ি করার কারণে তোমাদের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। স্মরণ রেখো, তোমাদের সকলকেই আল্লাহর সামনে হাজির হতে হবে। তাঁর কাছে সকল ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে। সাবধান! আমার পর তোমরা পথভ্রষ্ট হয়ো না, আত্মঘাতি রক্তপাতে লিপ্ত হয়ো না। আজকের এই হজ্বের দিন যেমন মহান, এই মাস যেমন মহিমামন্ডিত, মক্কার এই মসজিদুল হারাম যেমন পবিত্র, প্রতিটি মুসলমানের ধন-সম্পদ, মান-সম্ভ্রম, রক্ত এবং জীবন তেমনি পুতঃপবিত্র। এই পবিত্রতার হানিকারী মহাপাতক হিসেবে গণ্য হবে।
হে মানবমণ্ডলী! নিশ্চয়ই তোমাদের রব এক, তোমাদের আদি পিতা হযরত আদম (আ:) এক। সাবধান! অনারবের উপর আরবের, কিংবা আরবের উপর অনারবের, কালো বর্ণের মানুষের উপর সাদা বা লাল বর্ণের, কিংবা সাদা বা লাল বর্ণের মানুষের উপর কালো বর্ণের মানুষের কোনও শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আর প্রত্যেক মুসলমান একে অন্যের ভাই এবং সকলে মিলে এক অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃসমাজ। তোমাদের দাস-দাসীদের ব্যাপারে সাবধান! তোমরা যা খাবে তাদেরকে তাই খেতে দিও, তোমরা যা পরিধান করবে তাদেরকেও তাই পরিধান করতে দিও। এতে কোন রকম তারতম্য করো না।
হে বিশ্বাসীগণ! র্শিক করো না, অন্যায়ভাবে নরহত্যা করো না, পরস্ব অপহরণ করো না, ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়ো না। হে লোক সকল! শ্রবণ কর, গ্রহণ কর এবং নবজীবন লাভ করো। সাবধান! কোন মানুষের ওপর অত্যাচার করো না। সাবধান! কারও সম্মতি ছাড়া সামান্য ধনও গ্রহণ করো না। হে লোক সকল! নারীদের সম্পর্কে আমি তোমাদর সতর্ক করে দিচ্ছি যে, তাদের প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার করো না, আল্লাহর দণ্ডের ভয় করো। আল্লাহর কালামের ভিত্তিতেই তাদের সঙ্গে তোমাদের দাম্পত্য স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সহধর্মিনীগণের ওপর তোমাদের যেমন দাবি ও স্বত্বাধিকার আছে, তোমাদের ওপরও তাদের তেমনি দাবি ও স্বত্ত্বাধিকার রয়েছে।
হে আমার উম্মতগণ! শয়তান নিরাশ হয়েছে, এ শহরে আর শয়তানের উপাসনা হবে না। তবে নিজেদের কর্তব্য কর্মকে তুচ্ছ জ্ঞান করলে তাতেই শয়তান সান্ত¡না পাবে এবং খুশি হবে।
আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর বাণী রেখে যাচ্ছি যা তোমরা দৃঢ়ভাবে ধরে রাখলে কখনও পথভ্রষ্ট হবে না। মনে রেখো, আমার পর আর কোন নবী আসবে না, তোমাদের পর আর কোন উম্মতও থাকবে না। হে বিশ্বাসীগণ! সালাত কায়েম রেখো এবং যাকাত দিও। রমজান মাসে রোজা রেখো। হজ্ব আদায় করো। বৈধ শাসকের অনুগত থেকো। বংশের গৌরব করো না। যে ব্যক্তি নিজ বংশকে হেয় মনে করে এবং অপর কোন বংশের নামে আত্মপরিচয় দেয় তার ওপর নেমে আসে আল্লাহর অভিশাপ। তোমাদের মধ্যে যে উত্তম কাজ করবে সেই শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হবে।
আজ যারা উপস্থিত রয়েছো তারা অনুপস্থিতদের কাছে আমার বক্তব্য পৌঁছে দিও। উপস্থিত অনেকের চেয়ে অনুপস্থিত অনেকে আমার এই বক্তব্যকে অধিক গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করতে পারে।
হযরতের মুখমন্ডল ধীরে ধীরে স্বর্গীয় প্রভায় দীপ্ত এবং তার কণ্ঠ সত্যের তেজে বলিষ্ঠ হয়ে উঠলো এবং তিনি আকাশ পানে তাকিয়ে পরওয়ারদিগারের উদ্দেশে বললেন, হে আল্লাহ! আমি কি তোমার বাণী পৌঁছে দিয়েছি, আমি কি আমার কর্তব্য সম্পাদন করেছি? লাখো কণ্ঠে জবাব এলো, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। আল্লাহর রসুল বললেন, হে আমার রব, শোন এবং সাক্ষী থাকো।
এরপরই তাঁর ওপর নাজেল হয় সমাপ্তি সূচক প্রত্যাদেশ: “আজ ইসলাম পূর্ণাঙ্গরূপ লাভ করলো, তোমাদের ওপর আমার নেয়ামত সমাপ্ত হলো। ইসলামকে তোমাদের জীবন বিধান করা হলো। (সূরা ‘আল মায়েদা, আয়াত-৩)। শিয়া ঐতিহ্যের অনুসারীগণ বিশ্বাস করেন হজ্বের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে মদীনা প্রত্যাবর্তন কালে খোম জলাশয়ের কাছে পৌঁছালে আলোচ্য প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হয়েছিল। কোন তথ্য সঠিক তা আল্লাহই ভাল জানেন।
বিদায় হজ্ব থেকে প্রত্যাবর্তন করার পর হযরত মোহাম্মদ (স:) তিন মাস বেঁচেছিলেন। ৬৩ বছর বয়সে তিনি তাঁর স্বজন ও অনুসারীদের শোক সাগরে ভাসিয়ে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুন, ১১ হিজরীর ১২ রবিউল আওয়াল সোমবার নিজ গৃহে ইন্তেকাল করেন (ইন্নাহিল্লাহে অইন্না ইলাইহে রাজেউন)। তাঁর ইন্তেকালের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে আরবের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য প্রাণাধিক প্রিয় এই মানুষটির লাশের কাছে এসে ভিড় করেন এবং সুশৃঙ্খলভাবে শ্রদ্ধা জানিয়ে অশ্রুসজলনেত্রে বিদায় নিতে থাকেন। ফলে বিলম্বিত হতে থাকে তাঁর লাশ সমাহিত করার কাজ। মঙ্গলবার মতান্তরে বুধবার যেখানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন সেখানেই তাঁর স্বজনেরা যথাযোগ্য মর্যাদায় তাঁর লাশ সমাহিত করেন।
ইহুদী-খ্রিস্টান ঐতিহ্যের ধারায় হযরত মোহাম্মদ (স:) শেষ নবী হিসেবে একেশ্বরবাদ প্রচারে অতুলনীয় সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। পৃথিবীতে যত ধর্ম আছে তার মধ্যে ইসলামই সবচে সুসংবদ্ধ ধর্ম। এ ধর্মে জোর-জবরদস্তির কোন স্থান নেই। নেই বৈরাগ্য ও সন্ত্রাসের কোন সুযোগ।