হযরত বড়পীর (রহ:)-এর সারা জীবনই ছিল নসীহতের আধার। তার মুখ-নিঃসৃত প্রত্যেকটি বাণী, ওয়াজ-নসীহত, অমূল্য শিÿায় ভরপুর ছিল। তদুপরি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিষয়ের উপরে তিনি যে তাৎপর্যপূর্ণ উপদেশ করতেন তা চিরকাল অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। নিম্নে তাঁর কিছু বিবরণ পেশ করছি।
আলøাহ পাকের শ্রেষ্ঠ ও মহান পবিত্র নামকে ‘ইসমে আযম’ বলা হয়ে থাকে। ফজীলত, মর্তবা ও মাহাত্ম্যের ÿেত্রে এই নামটি শীর্ষস্থান দখল করে আছে। পবিত্র কোরআন ও হাদীস শরীফে এই সম্বন্ধে সুস্পষ্ট বর্ণনা ও ইঙ্গিত না থাকায় আলেম সম্প্রদায় এতে মতভেদ পোষণ করে থাকেন। কিন্তু ইসমে আযমের গূঢ়তত্ত্ব উদঘাটনে মানুষের চেষ্টার বিরাম নেই।
ইসমে আযম সম্পর্কিত হযরত বড়পীর (রহ:)-এর অভিমতগুলো ‘কালাইদুয যাওয়ান্নাহির’ নামক কিতাবে সুন্দরভাবে সন্নিবেশিত রয়েছে। এই সম্পর্কে বড়পীর (রহ:)-এর অভিমত এই যে, ‘আলøাহ’ নামটি হইল ইসমে আযম। যখন যিকির ও স্মরণকারীর হৃদয়ে আলøাহ ছাড়া অন্য কোন কিছুরই অ¯িÍত্ব জাগরূক থাকে না, তখনই সালেক এই নামের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতে পারে। এই কথা স্পষ্টত বলা যায় যে, আলøাহ পাক কোনকিছু সৃষ্টি করতে ইচ্ছা করলে তিনি বলেন, ‘কুন’ অর্থাৎ হয়ে যাও। আর তা হয়ে যায়। অনুরূপভাবে রুহানী জগতে ‘আলøাহ’ নামটি ‘কুন’ সদৃশ। আর আলøাহ নামের ফল ‘কুন’-এর মত সক্রিয়।
বড়পীর (রহ:) বলেছেনБহে লোক সকল! জেনে রাখ, আলøাহর নাম যাবতীয় দুশ্চিন্তা, দুঃখ, কষ্ট, বিষণœতা, শোক-যাতনা, বেদনা হাহাকার দূর করে দেয় এবং সর্বপ্রকার বিপদসঙ্কুল ও কঠিন কাজ সহজসাধ্য করে। এই শব্দের তেজে বিষের ক্রিয়া বিনষ্ট হয়। তাঁর শাশ্বত নূর সর্ববিজয় ও চির অÿয়। ইহা সর্বত্র সমানভাবে আগেও বিদ্যমান ছিল, এখনও আছে এবং অনন্তকাল থাকবে। আলøাহ সকল বিজয়ী হতে শ্রেষ্ঠ বিজয়ী। তাঁর কুদরতের ভেতর দিয়ে সর্বপ্রকার রহস্যময় ঘটনাপুঞ্জ ও বিস্ময়কর কার্যাবলী আত্মপ্রকাশ করে। তার আধিপত্য সর্বোপরি ÿমতার সোপান। আলøাহ বান্দাদের হৃদয়স্থিত গোপনীয় ভেদসমূহের যাবতীয় অবস্থা পরিজ্ঞাত। গর্বিতদের গর্ব চূর্ণ ও ÿমতাবানদের ÿমতা ধ্বংস করা তার ইঙ্গিতে সাধিত হয়। ছোট-বড়, জাহের-বাতেন সবকিছুই তিনি ওয়াকেফহাল। তাঁর জ্ঞানসীমার বাইরে কোনকিছুই নেই। তিনি আলøাহ-ওয়ালাদের স্বয়ং হেফাজত করেন। আলøাহ প্রেমিক ব্যক্তি অন্যতে আকর্ষণ অনুভব করে না। আলøাহর পথের পথিক তাহার রহমতের ছায়াতলে নৈকট্য লাভ করে। যে আলøাহর জন্য সচেষ্ট; আলøাহও তার জন্য সচেষ্ট থাকেন। যে পার্থিব সুখ-শান্তি, বিষয়-বৈভব আলøাহর দীদারের আশায় বর্জন করে, তার সময় আলøাহর নৈকট্যের মধ্য দিয়ে কাটে। আর সে তদবস্থায় আলøাহর সাথে গোপন প্রেমালাপে মত্ত থাকে।
হে খোদাবিস্মৃত বান্দাগণ! পার্থিব জগতে আলøাহর নামের প্রবলানুরাগ অনুধাবন করতঃ আলøাহর দিকে ফিরে যাও। জেনে রাখ শান্তিময় চিরস্থায়ী জগৎ আখেরাতে এই নামের চর্চা সর্বাধিক হবে। পার্থিব দুনিয়ায় যে আলøাহ তোমাদিগকে অসংখ্য অযাচিত দানে কৃতার্থ করেছেন তিনি আখেরাতেও তোমাদিগকে বঞ্চিত করবেন না; বরং সেখানেও তোমাদিগকে বহু কিছু প্রদান করবেন।
সময় থাকতে আলøাহর যিকির কর। তার দ্বারপ্রান্তে পড়ে থেকে তাকে স্মরণ কর। তা হলে আলøাহ এবং তোমাদের মধ্যকার আবরণ দূর হবে এবং জ্যোতির্ময়ের অবিনশ্বর আলোর ঝর্ণাধারা উদ্ভাসিত হবে। তখন দেখবে অসংখ্য প্রেম ভিখারী তার অনুপম সৌন্দর্য দেখে আত্মভোলা হয়ে পড়েছে। কত প্রেমিক প্রেমের সাগরে ভেসছে। তখন তুমি আরো দেখতে পাবে যে, প্রেমাস্পদের বিরহ বেদনায় যে চাতক সকাল হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত করুণ স্বরে বিলাপ করত, প্রত্যুষ হতে দিনান্ত পর্যন্ত মুদিত নয়নে অধীর প্রতীÿায় বিনিদ্র রজনী অতিবাহিত করত, সে পরম প্রেমাস্পদের মধুর মিলনে সার্থক হয়েছে।
রেযা, তাসলীম, শওক এবং ইশতিয়াকের পন্থা গ্রহণ করতে হবে আলøাহর নির্ধারিত নির্দেশাবলী, ইচ্ছায়, অনিচ্ছায়-কায়মনে, নিঃসঙ্কোচে পালনের নামই তাসলীম। আর আলøাহর নিকট হতে অভাব-অনটন, রোগ-শোক, দুঃখ-কষ্ট কিংবা বিপদাপদ আপতিত হলে অসন্তুষ্টি ও বিরক্তি এবং উৎকণ্ঠা প্রকাশ না করাকে রেযা বলে আর আলøাহর দীদারের জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীÿায় থাকাকে শওক ও ইশতিয়াক বলে। এই সম্পর্কে আলøাহ বলেন, যে ব্যক্তি আলøাহর উপর নির্ভর করে তার আলøাহই যথেষ্ট। সুতরাং শওক ও ইশতিয়াকের সাথে আলøাহকে স্মরণ কর। ফলে তাঁর দীদার ও নৈকট্য লাভ করবে। স্তুতি ও প্রশংসার সাথে তাকে স্মরণ কর, তিনি তোমাদের করুণার সাথে স্মরণ করবেন এবং যথার্থ পুরস্কার প্রদান করবেন। যদি তোমরা তওবা ও অনুশোচনা দ্বারা তাকে স্মরণ কর তা হলে তিনি ÿমা ও কৃপার সাথে তোমাদেরকে স্মরণ করবেন। আর যদি নিজের আমিত্বকে বিসর্জন দিয়ে স্মরণ কর তবে তিনি অমরত্ব দানসহ তোমাদেরকে স্মরণ করবেন। আর যদি নম্রতা ও কাকুতি-নিমতির সাথে স্মরণ কর, তবে তিনি অপরাধ ÿমা করতঃ বেশি করে স্মরণ করবেন। যদি তোমরা অকপটভাবে তাকে স্মরণ কর, তবে তিনি অশেষ জীবিকা প্রদানপূর্বক স্মরণ করবেন। যদি তোমরা শ্রদ্ধা ও ভক্তিসহ তাকে স্মরণ কর, তা হলে তিনি ইজ্জত, মর্যাদা ও সম্মান বৃদ্ধি করতঃ তোমাদের স্মরণ করবেন। যদি অবিচার, অত্যাচার, পাপাসিক্ত ত্যাগপূর্বক স্মরণ কর, তবে আগ্রহাতিশয্যে তিনি তোমাদেরকে স্মরণ করবেন। যদি অন্যায়, গর্হিত কর্ম ও পাপ পরিত্যাগ করে স্মরণ কর, তবে তিনি অনুগ্রহ, ÿমা ও করুণা দান করতঃ তোমাদেরকে স্মরণ করবেন। আর যদি ইবাদত-বন্দেগীসহ তাকে স্মরণ কর, তবে তিনি অফুরন্ত নেয়ামতসমূহ দান করে স্মরণ করবেন।
যদি তোমরা সর্ব¯Íরে সর্বস্থানে, সর্বমুহ‚র্তে, তাকে স্মরণ কর, তবে তিনিও তোমাদেরকে অনুরূপ প্রতিদানসহ স্মরণ করবেন। তোমরা কুরআনের নিম্ন আয়াতটি গভীর মনোযোগ ও নিষ্ঠার সাথে স্মরণ রাখিও। ইরশাদ হচ্ছে সাবধান! আলøাহর স্মরণই সর্বশ্রেষ্ঠ, আলøাহ তোমাদের কার্যাবলী সম্পর্কে পরিজ্ঞাত।
হযরত বড়পীর (রহ:) মোত্তাকীগণের জন্য দশটি অমূল্য উপদেশ দান করেছেন।
১। প্রকাশ্য, অপ্রকাশ্য ও জাহেরী-বাতেনী, সমুদয় পাপরাশি বর্জন কর ও নিজের অঙ্গাবয়ব হেফাজত কর। তবে অতিসত্বরই তোমার অন্তর প্রদেশে তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এর সুন্দর প্রতিক্রিয়া পরিস্ফ‚ট হয়ে উঠবে। ২। স্বীয় জীবিকা সংস্থানের দায়-দায়িত্ব অন্য কারও উপর ন্য¯Í করো না। এটা আলøাহর দায়িত্ব। তবেই তুমি ‘আমরু বিল মারুফ’ এবং ‘নেহি আনিল মুনকার’-এর দায়িত্ব ও কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারবে। আর সৎকাজে নির্দেশ ও অসৎ কাজে নিষেধের মধ্যেই পরম সম্মান। আর এতে দৃঢ় বিশ্বাস ও আত্মনির্ভরশীলতার পরিমাপ সহজ হবে। ৩। মানুষের নিকট সামান্য আশা করা হতেও বিরত থেকো। কেননা এতেই সম্মান, মর্যাদা, নির্ভরশীলতা ও শ্রেষ্ঠত্ব নিহিত। আর এটা দ্বারা অনর্থক কাজ, কথা, চিন্তা-ভাবনা হতে মুক্তিলাভ করবে। ৪। কোন মুসলমানকে নিশ্চিতভাবে মোনাফেক বা কাফের বলতে নেই। এটাই সুন্নত তরীকা। আলøাহ ছাড়া কে মোনাফেক কে মোশরেক এবং কে কাফের তা জানে না। যদি এই ধরনের পরিচয়ে কাকেও অভিযুক্ত না কর তবে আলøাহর জ্ঞানে অনধিকার চর্চা হতে পরিত্রাণ লাভ করবে এবং আলøাহর রহমত লাভে কৃতার্থ হবে। ৫। কাকেও বদদোয়া ও অভিসম্পাত করো না। ধৈর্য ও সংযমের সাথে তোমার ওপর আপতিত অবিচার ও দুঃখ-কষ্ট সহ্য কর। ফলে লোকজন তোমাকে মহব্বত করবে ও ভক্তি-শ্রদ্ধার চোখে দেখবে। ৬। বিনয়, নম্রতা, শিষ্ঠাচার ও আদবের মধ্যেই ধর্মভীরুতা ও সর্বাধিক মর্যাদা নিহিত। এটা অবলম্বন কর। কেননা স্বভাব-চরিত্র দ্বারাই ভাল লোকের অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায়।৭। আর কাকেও অভিশাপ ও বদদোয়া দিও না। সত্যপরায়ণ ও পুণ্যবান লোকদের এটাই কাজ। তবেই আলøাহ পাক তোমার মর্যাদা সমুন্নত ও অÿুণœ রাখবেন এবং অন্যের অনিষ্টকারিতা হতে বাঁচাইয়া দিবেন। ৮। মিথ্যা কথা বর্জন কর। হাসি-তামাশা, ঠাট্টা-বিদ্রæপ ও কৌতুকবশতও মিথ্যা বলো না। যদি সত্য কথা বলবার অভ্যাস করতে সÿম হও, তবে আলøাহ তোমাকে রূহানী দৃষ্টিশক্তি ও এলেম প্রদান করবেন। ৯। আলøাহর নামে শপথ করো না। হুঁশিয়ার! তোমার যবানে যেন ‘আলøাহর নামে শপথ’ উচ্চারিত না হয়। এইভাবে নিজের স্বভাব গঠন করতে পারলে তোমার অন্তরে আলøাহর নূরের জ্যোতি প্রবিষ্ট হবে এবং তুমি উচ্চ মর্যাদায় সমাসীন হবে, সৎকর্মের স্পৃহা বৃদ্ধি পাবে। ১০। শপথ ও প্রতিজ্ঞা করা হতে বেঁচে থাক। এতে তোমাকে বদান্যতা ও লজ্জাশীলতার শ্রেষ্ঠ মর্যাদা দান করা হবে।
গ্রন্থনা :
মাওলানা জাকির হোসাইন আজাদী