আল্লাহর রাসুল মুহাম্মদ(সঃ)

আরবের ধূসর মরুর উষর বুকে ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট [মতান্তরে ২০ আগস্ট] মতান্তরে ৫৭১ খ্রিস্টাব্দের ২০ [অথবা ২১] এপ্রিল [৯ মতান্তরে ১২ রবিউল আউয়াল] সোমবার মহাপুরুষ হযরত মোহাম্মদ (স:) মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ গোত্রের সম্ভ্রান্ত হাশিম শাখায় জন্মগ্রহণ করেন। মিশরের বিখ্যাত জ্যোতিষশাস্ত্রবিদ মাহমুদ পাশা ফালাকী গাণিতিক যুক্তিতর্কের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন যে, হযরত মোহাম্মদ (সঃ) ৫৭১ খ্রিস্টাব্দের ২০ এপ্রিল রবিউল আউয়াল মাসের ৯ তারিখ, সোমবার সুব্হে সাদিকের অব্যবহিত পরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল্লাহ এবং মাতার নাম আমিনা বিনতে আব্দুল ওয়াহাব জহরি।
মানচিত্রের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, আরবের পশ্চিমে লোহিত সাগর, পূর্ব-উত্তরে দজলা বা টাইগ্রীস নদ, পারস্য উপসাগর, ওমান উপসাগর ও আরব সাগর। দক্ষিণে ভারত মহাসাগর। উত্তরে আলেপ্পো শহর ও ফোরাত নদী। জলবায়ু চরমভাবাপন্ন। বারো মাস ঝড়ো হাওয়া বইলেও বৃষ্টিপাত হয় খুবই সামান্য। পূর্ব-পশ্চিম ও দক্ষিণে সমুদ্র বেষ্টিত হওয়া সত্বেও আরব তরুলতাহীন পর্বত ও মরুময় এক অঞ্চল। তবে মরুপ্রান্তরের মাঝে-মধ্যে স্বচ্ছ ঝর্ণাস্রোত, খেজুর আর ডালিমের সিগ্ধ মরুদ্যান মানুষের বসতির জন্য অনেকটা অনুকূল। মরুর বিভিন্ন জনপদে পশুসম্পদ বলতে ছিল উট, ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া ও গাধা। যদিও মাটির নীচে ছিল সোনাসহ নানা খনিজ দ্রব্য এবং তেল। মরু সন্তানেরা ছিল সাহসী ও যুদ্ধপ্রিয়। লুক্তনবৃত্তিকে তারা সম্মানজনক পেশা মনে করতো। আরবের সাহিত্য-সংস্কৃতি তুলনামূলক বিচারে খুব অনুজ্জ্বল ছিল না। হযরত মোহাম্মদ (স:)-এর আবির্ভাবকালে উজ্জ্বল ঐতিহ্যের আরব ভূমি অন্ধকারে ডুবে ছিল। পরাধীনতার অভিশাপ তার ইতিহাসকে কলংকিত না করলেও সামাজিক ও নৈতিক অধঃপতন চরম সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল।
মোহাম্মদ (স:) ছিলেন মানবতার মূর্তপ্রতীক। তিনি পৃথিবীর সকল প্রান্তের এবং সকল স্তরের মানুষের কাছে কেয়ামত বা মহাপ্রলয়ের দিন পর্যন্ত অনুসরণযোগ্য সুমহান চারিত্রিক ও মানবিক গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে চল্লিশ বছর বয়সে তিনি নবুয়ত লাভ করেন। ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি মদীনায় হিজরত করেন। ৬৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুলাই ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুক (রা:)-এর শাসনামলে তাঁর মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের দিনকে ইসলামী বর্ষপঞ্জির সূচনা ধরে হিজরী সন প্রবর্তন করেন। অল্প সময়ের মধ্যে ধর্ম হিসেবে ইসলাম আরবের বিপুল জনগোষ্ঠীর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে এবং একইসঙ্গে নবী হিসেবে তিনি সকলের কাছে সুমহান মর্যাদায় সমাসীন হন। ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারী তিনি তাঁর অনুসারী-অনুগামীদের নিয়ে শেষ হজ্বব্রত পালন করতে মক্কায় রওয়ানা হন এবং ৭ মার্চ মক্কায় পৌঁছান এবং ৮ মার্চ [৯ই জিলহজ্জ] বিদায় হজ্বের ভাষণ দেন। এর তিন মাস পর তিনি ইন্তেকাল করেন।
মোহাম্মদ (স:) নামের অর্থ চরম প্রশংসাকারী। সমগ্র পৃথিবীতে যে সকল বিখ্যাত ব্যক্তি জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁদের মধ্যে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ। লোহিত বর্ণের বালুকারাশিতে পূর্ণ আরবের দুর্গম মরু অঞ্চলে এ পর্যন্ত যত রাজা-বাদশাহ, কবি-দার্শনিক জন্মেছেন, মোহাম্মদ (স:) সকল দিক থেকেই তাদের সবাইকে অতিক্রম করে গেছেন। তিনি ছিলেন নেতাদের নেতা, রাজাদের রাজা, দার্শনিকদের দার্শনিক। মোহাম্মদ (স:) তাঁর চারিত্রিক মাধুর্যে, দৃঢ় সংকল্পে আর আপন মহত্ত্বে আরব জাহানকে সম্পূর্ণভাবে বদলে দেন। তাঁর বদৌলতেই আরবে নবজীবন সঞ্চারিত হয়, নতুন সংস্কৃতির উন্মেষ ঘটে, নবীন সভ্যতার গোড়াপত্তন হয় এবং উদ্ভব ঘটে একটি নতুন জীবন ব্যবস্থার। অচিরেই এই সভ্যতার আলো ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা থেকে মরক্কো হয়ে ভারতবর্ষের দ্বীপপুঞ্জ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। তাছাড়া হযরত মোহাম্মদ (স:)-এর সাম্য ও স্বাধীনতার আদর্শ এবং মানব কল্যাণের চিন্তা-চেতনা এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপ মহাদেশের চিন্তা ও জীবনধারাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
ইতিহাসের অন্যতম প্রধান ও প্রভাবশালী ধর্মীয় এবং সামরিক নেতা মহানবী হযরত মোহাম্মদ (স:) জন্মের ছয়মাস আগেই পিতৃহীন হন। পিতৃহীন এই সন্তানের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পড়ে তাঁরই পিতামহ ও সম্ভ্রান্ত হাশেম গোত্রের তদানীন্তন প্রধান আবদুল মুত্তালিবের উপর। তিনি তাঁর প্রতিপালনের জন্য সা’দ বংশের হালিমা নামের এক বেদুইন মহিলাকে অর্থের বিনিময়ে দুধ পান করানোর ব্যবস্থা করে দেন। ছয় বছর পর দুধমাতা হালিমা তাঁকে তাঁর মা আমিনার কাছে ফেরত পাঠানোর পর তিনি তাঁর স্বামীর কবর জিয়ারত করার উদ্দেশ্যে শিশুপুত্র মোহাম্মদ ও পরিচারিকা উম্মে আইমানকে সঙ্গে নিয়ে মক্কা থেকে তিনশত মাইল পূর্বে মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। তারা মদীনায় পৌঁছে সেখানে একমাস অবস্থান করেছিলেন। মায়ের সঙ্গে মদীনায় অবস্থানের স্মৃতি তাঁর স্মরণে ছিল। মদীনা থেকে মক্কা অভিমুখে অর্ধেকটা পথ অতিক্রম করার পর ‘আবওয়া’ নামক একটি গ্রামে হঠাৎ তাঁর আম্মাজান অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অপ্রতাশিতভাবে মৃত্যুবরণ করেন। সেখানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। উম্মে আইমান মাতৃ-পিতৃহীন শিশু মোহাম্মদকে মক্কায় তাঁর পিতৃব্য আবদুল মুত্তালিবের কাছে বুঝিয়ে দেন। মক্কার কুরাইশদের সঙ্গে মুসলমানদের হোদাইবিয়ার সমঝোতা চুক্তি হওয়ার পর মক্কা থেকে মদীনা প্রত্যাবর্তন করার পথে আবওয়া গ্রামে রসুল তাঁর মায়ের কবর জিয়ারত করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন।
তাঁর পিতৃব্য ইন্তেকাল করলে তাঁকে লালন-পালন করেন চাচা আবু তালিব। বালক মোহাম্মদের বয়স যখন ১২ বছর তখন তাঁর চাচা আবু তালিব ব্যবসায়ের কাজে রওয়ানা হলে বালক মোহাম্মদ তাকেও সঙ্গে নেবার জন্য অনুনয়-বিনয় শুরু করেন। দুর্গম মরু যাত্রায় কষ্টের কথা ভেবে তিনি তাকে সঙ্গে নিতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু ভ্রাতুষ্পুত্র মোহাম্মদ উটের লাগাম ধরে এই বলে কাঁদতে শুরু করলেন যে, ‘আমার না আছে বাবা, না আছে মা, আমাকে একা ফেলে আপনিও চলে যাচ্ছেন, আমাকেও আপনার সঙ্গে নিয়ে যান।’ বালকের এ কাতর আবেদনকে উপেক্ষা করা তাঁর পক্ষে আর সম্ভব হলো না। তিনি শাম (সিরিয়া) দেশের দিকে বাণিজ্য করতে যাচ্ছিলেন। এ যাত্রায় বালক মোহাম্মদকেও তিনি সঙ্গে নিতে বাধ্য হন। এভাবেই বৃহত্তর বিশ্বের সঙ্গে তাঁর পরিচয় লাভের সুযোগ ঘটে এবং মোহাম্মদ (সঃ)-এর জীবনে নতুন অধ্যায় শুরু হয়।
আরবের বিখ্যাত ওকাজ মেলাতেই গোত্র বিরোধ থেকে ফেজার যুদ্ধ সংগঠিত হয়। সকল গোত্র ও গোষ্ঠী এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এই যুদ্ধে তরুণ মোহাম্মদও তাঁর পিতৃব্যদের সঙ্গী ছিলেন। দীর্ঘস্থায়ী গোত্রযুদ্ধের ফলে মক্কায় ইয়াতিম, বিধবা এবং নিঃসহায় মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। হত্যা, লুঠতরাজ অভ্যাসে পরিণত হতে থাকে। দুর্বলের ওপর নিপীড়ন ও নির্যাতনের দৌরাত্ম চলতে থাকে। অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য জনআকাঙক্ষাও বাড়তে থাকে। ফুজজার যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তন করার পর মোহাম্মদ (সঃ)-এর কনিষ্ঠ পিতৃব্য জুবাইর ইবনে আবদুল মোত্তালিবের প্রস্তাবক্রমে বনু হাশিম, বনু যুহরা ও বনু নাঈম ইত্যাদি গোত্রের লোকজন মক্কার অন্যতম সৎ ও দানশীল ব্যক্তি আবদুল্লাহ ইবনে জা’দআনের গৃহে সমবেত হয়ে একটি চুক্তিপত্র সম্পাদন করেন এবং ‘হিলফুল ফুজুল’ নামের একটি সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। অসহায় ও দুর্গত মানুষকে সাহায্য করার অঙ্গীকার নিয়ে গঠিত এই সংগঠনটি। হতাশার ঘোর অন্ধকারের মধ্যে কিঞ্চিত আশার আলো সঞ্চার করেছিল। হযরত মোহাম্মদ (সঃ) এই সমাজ সেবামূলক সমিতির সাংগঠনিক তৎপরতায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। উৎপীড়িত ও অত্যাচারিতকে সাহায্য করার অঙ্গীকারের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন বলেই খাদ্যের অভাবে ক্রন্দনরত অনাথের দুঃখ মোচনে, বিধবা নারীর কান্না থামাতে এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তিনি তৎপর হয়েছিলেন। আর্থ-সামাজিক সমস্যার প্রতিকার চিন্তায় তাঁর সততা, আন্তরিকতা ও বিশ্বস্ততা সবার শ্রদ্ধা কেড়েছিলো। তিনি সত্যবাদী, শান্তিপ্রিয় এবং পরম বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসেবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিলেন। এই গুণাবলী এবং ভাবমূর্তি পরবর্তীকালে তাঁকে ব্যবসায়ী জীবনে অভাবিত সাফল্য এনে দিয়েছিল। প্রতিশ্রুতি রক্ষায় তাঁর খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। মক্কার ধনাঢ্য ব্যবসায়ী খাদিজার বাণিজ্য কাফেলার প্রধান পদে নিয়োগ লাভের জন্য তাঁর এই বিশ্বস্ত ভাবমূর্তি বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। বাণিজ্যিক কাজে তাঁর দক্ষতা ও আর্থিক লেন-দেনের ক্ষেত্রে তাঁর স্বচ্ছতা ধনাঢ্য ও বিদুষী রমনী খাদিজাকে মুগ্ধ করেছিল।
নবুয়ত প্রাপ্তির পূর্বেই মক্কার সমাজে তাকে ‘আল আমীন’ এবং ‘আস-সাদিক’ বলা হতো। চাচা আবু তালিবের অনুরোধে মক্কার ধনাঢ্য বিধবা মহিলা খাদিজা বিনতে খোয়াইলিদ তাঁকে ব্যবসার কাজে নিয়োগ করেন এবং বাণিজ্য কাফেলার সঙ্গে সিরিয়া পাঠান। ঐ বছর ব্যবসায় খাদিজার প্রচুর লাভ হয়। পঁচিশ বছর বয়সে মোহাম্মদ (স:) তাঁর চেয়ে পনেরো বছরের বড় এই বিধবা মহিলা খাদিজাকে বিয়ে করেন এবং তাঁর সঙ্গে হযরত মোহাম্মদ (স:) পঁচিশ বছর সংসার জীবন যাপন করেন। তাঁদের দাম্পত্য জীবন অত্যন্ত মধুর ছিল। তার গর্ভে তিন পুত্র-কাসেম, তাইয়েব ও তাহের এবং চার কন্যা- জয়নব, রুকাইয়া, কুলসুম ও ফাতেমা জন্মলাভ করেন। শৈশবেই তিন পুত্রের মৃত্যু হয়। জ্যেষ্ঠা কন্যা জয়নবের বিয়ে হয় আবুল আসের সঙ্গে। রুকাইয়ার বিয়ে হয় হযরত উসমান (রা:)-এর সঙ্গে এবং রুকাইয়ার মৃত্যুর পর তিনি কুলসুমকে বিয়ে করেন। সর্বকনিষ্ঠা ফাতেমার বিয়ে হয় হযরত আলী (রা:)-এর সঙ্গে। পরবর্তীকালে তাঁর স্ত্রী মারিয়া কিবতিয়ার গর্ভে ইব্রাহীম নামে আরও একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করেন। তিনিও কিশোর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
খাদিজাসহ আল্লাহর রসুল (স:) যে সকল নারীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তাদের মোট সংখ্যা ১১, মতান্তরে ১৩। খাদিজা (রা:)-এর জীবদ্দশায় তিনি অন্য কোন নারীর সংগে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হননি। তাঁর সহধর্মীনীদের মধ্যে একমাত্র হযরত আবু বকর (রা:)-এর কন্যা আয়েশা (রা:) ছিলেন কুমারী। হযরত খাদিজা (রা:) এবং হযরত জয়নব (রা:) তাঁর জীবদ্দশায় মারা যান। অপর নয়জন মতান্তরে এগার জন তাঁর মৃত্যুকালে জীবিত ছিলেন।
তাঁর বয়স যখন ৩৫ বছর তখন আগুন লেগে কাবা ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোরাইশরা কাবা পুনঃনির্মাণ করেন। কিন্তু হজরে আসওয়াদটি যথাস্থানে বসানো নিয়ে শুরু হয় বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে মর্যাদার লড়াই। হযরত মোহাম্মদ (স:) একটি চাদর বিছিয়ে তার উপর নিজ হাতে হজরে আসওয়াদ রেখে সকল গোত্রের লোককে চাদর ধরে উপরে উঠাতে বলেন। পরে তিনি নিজ হাতে পাথরটিকে যথাস্থানে বসিয়ে দেন। সবাই তাঁর এই উপস্থিতবুদ্ধি দেখে চমৎকৃত হন।
তাঁর বয়স যখন ৪০-এর কাছাকাছি তখন তিনি নির্জনতা ভালবেসে মক্কার উত্তরে অবস্থিত হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকা শুরু করেন। খাড়া এই পর্বতটির উচ্চতা ২০০ মিটার। এই পর্বতের গুহায় বসে তিনি মক্কা নগরীর নৈতিক ও সামাজিক অধঃপতন নিয়ে গভীর চিন্তায় ধ্যানমগ্ন থাকতেন। ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে একদিন হেরা পর্বতে ধ্যানমগ্ন থাকা অবস্থায় তিনি আচমকা এক গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনে হতচকিত হয়ে পড়েন। তাকে বলা হয়-‘পড়ো, তোমার প্রভুর নামে- যিনি সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা এবং ঘণীভূত শোনিত হতে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। পড়ো, তোমার মহিমান্বিত প্রভুর নামে, যিনি লিখতে শিখিয়েছেন এবং শিক্ষা দিয়েছেন এমন বিষয়াদি-যা তার জানা ছিলো না’। (কোরআন-৯৬: ১-৫)
এই ঘটনায় নিজের ক্ষতির আশঙ্কায় তিনি বিচলিতবোধ করতে থাকেন। কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফিরে এসে তিনি স্ত্রী খাদিজাকে তাঁর দেহ কম্বল দ্বারা আবৃত করে দিতে বলেন। তিনি তাকে সান্ত¡না দেন এবং তাকে তাঁর চাচাতো ভাই ইহুদিপণ্ডিত ওয়ারাকা বিন নওফেলের কাছে নিয়ে যান। বিচক্ষণ এই মনীষী ঘটনার বিবরণ শুনে হযরত মোহাম্মদ (সা:)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করেন। হযরত মুসা (আ:)-এর কাছে যে ফেরেশতার আগমন ঘটেছিল মোহাম্মদ (স:)-এর কাছেও সেই জিব্রাইল (আ:)-এর আগমণ ঘটেছে বলে তিনি জানান। সহধর্মীনী খাদিজা (রা:)-ই প্রথম হযরত মোহাম্মদ (স:)কে আল্লাহর রসুল বলে স্বীকার করে নেন।
ইসলাম ধর্মের মূল কথা হচ্ছে: একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কোন কিছুই পূজা-অর্চনা পাবার যোগ্য নয় এবং হযরত মোহাম্মদ (স:) এই শাশ্বত সত্যের বাহক। প্রথম তিন বছর গোপনে এরপর প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্য তিনি আদিষ্ট হন। এই সময়ে তিনি প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখে পড়েন। যারা তাঁর নতুন ধর্মমতে দীক্ষা নেন তাদের ওপর নেমে আসে নির্যাতন ও জুলুম। তবে তাঁর চাচা হযরত হামজাহ এবং ওমর বিন খাত্তাব ইসলাম গ্রহণ করলে পরিস্থিতি নবীন ধর্মের অনুসারীদের জন্য কিছুটা সহনীয় হয়ে আসে। এক পর্যায়ে কোরাইশগণ লোভ ও প্রলোভন দেখিয়ে নবধর্ম ইসলামের বিস্তার ঠেকানোর চেষ্টা করে। হযরত মোহাম্মদ (স:) পরিষ্কার ভাষায় বলে দেন যে, “আমার এক হাতে চাঁদ আর অন্য হাতে সূর্য এনে দিলেও সত্য প্রচার থেকে আমি বিরত হবো না।”
আদর্শের প্রশ্নে অবিচল থাকায় তাঁকে হত্যা করার চক্রান্ত শুরু হয়। এক পর্যায়ে বনু হাশেম এবং বনু মুত্তালিব গোত্র ঐক্যবদ্ধভাবে নবী মোহাম্মদ (স:)কে রক্ষার জন্য সংকল্পবদ্ধ হলে অন্যান্য গোত্রের লোকেরা বুঝতে পারে যে, মোহাম্মদ (স:)কে হত্যা করতে গেলে মক্কায় রক্তের স্রোত বয়ে যাবে। তাই তারা হত্যার পরিকল্পনা সাময়িকভাবে স্থগিত রেখে নির্যাতনের নতুন পন্থা উদ্ভাবন করে। তারা একত্র হয়ে বনু হাশেম ও বনু মুত্তালিব গোত্রের লোকদের অবরুদ্ধ করে রাখার অনুকূলে এক লিখিত চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। চুক্তিপত্রটি লিখেছিলেন বুগাইজ ইবনে আমের ইবনে হাশেম। চুক্তি অনুযায়ী আবু লাহাব ব্যতীত বনু হাশেম ও বনু মুত্তালিবের নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী, শিশু-কিশোর, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সকলকে শি’বে আবু তালিব নামক ঘাঁটিতে অবরুদ্ধ রাখা হয়। হযরত মোহম্মদ (স:)-এর নবুয়ত লাভের সপ্তম বছরে এই ঘটনা ঘটে এবং তিন বছর যাবৎ অবরুদ্ধ নারী-পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধরা অমানবিক জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়।
নবুওয়ত লাভের দশম বছরে তাঁর চাচা এবং শক্তিশালী অভিভাবক আবু তালিব এবং এর পাঁচ সপ্তাহ পরে জীবনসঙ্গিনী হযরত খাদিজা (রাঃ) ইন্তেকাল করেন। এই সময়ে তিনি নিজেকে কিছুটা অসহায় মনে করতে থাকেন। তিনি মক্কা থেকে ৭০ মাইল দক্ষিণে তায়েফ গমন করেন। কিন্তু তায়েফের লোকেরা তাঁকে উপহাস ও লাঞ্ছিত করে। তাঁর পেছনে গুণ্ডাদের লেলিয়ে দেয়া হয়, যারা পাথর মেরে তাঁর পবিত্র দেহকে রক্তাক্ত করে দেয়। তারপরও তিনি হাত তুলে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে বলেন : “হে আল্লাহ, তুমি পরম দয়ালু ও সর্বশক্তিমান। অবিশ্বাসীরা না বুঝে আমার ওপর আক্রমণ চালিয়ে যে অপরাধ করেছে, আমি তাদের জন্য তোমার কাছে করুণা ভিক্ষা করছি। তোমার নিরাপত্তাই আমার জন্য যথেষ্ট। তুমি দয়া করে তাদেরকে ক্ষমা করে দাও। তাদেরকে শাস্তি দিও না। তুমি আমাদের ত্যাগ করো না এবং কখনো শত্রুদের হাতে তুলে দিও না। অবিশ্বাসীরা যে তোমার বাণী গ্রহণ করছে না এজন্য তাদের কোন দোষ নেই, দায়ী আমার দুর্বলতা, আমার অক্ষমতা। হে রহমানুর রহিম, একমাত্র তুমিই দুর্বলের বল, তুমি ছাড়া আমার আর কোন সাহায্যকারী নেই। তুমি আমাকে সাহায্য কর। আমাকে জয়যুক্ত কর। একমাত্র তোমার সন্তুষ্টিই আমার কাম্য। তুমি সন্তুষ্ট থাকলে আমি দুনিয়ার কাউকে ভয় করি না। তুমি আমার উপর রুষ্ঠ হয়ো না। যারা আমার ওপর শত্রুতা করছে, অনুগ্রহ করে তাদেরকে সৎ পথে চালিত কর। তারা জানে না তারা কি করছে। তুমি দ্বীন-দুনিয়ার মালিক, আশ্রয়হীনের আশ্রয়দাতা, নিঃসহায়ের সহায়।” আল্লাহর রসুলের দোয়া শেষ হলে ওহী নাজিল হয় ঃ ধৈর্য ধরুন, চরম ধৈর্য। নিশ্চয়ই তারা দেখছে বিজয় সুদূরপরাহত কিন্তু আমরা দেখছি বিজয় নিকটবর্তী। (সুরা ৭০, আয়াত ৫-৭)
তাঁর এই করুণ আবেদনে সাড়া দিয়ে ফেরেশতারা তায়েফবাসীকে সমুচিত শিক্ষা দিতে চাইলে তিনি তাদের অকল্যাণ কামনা থেকে বিরত থাকেন এবং এই মর্মে আশা প্রকাশ করেন যে, প্রত্যাখ্যানকারীদের বংশে এমন মানুষ জন্ম নেবে যারা শুধু আল্লাহরই বন্দেগী করবে, কাউকে তাঁর শরীক করবে না। এই সহিষ্ণু ও ক্ষমাসুন্দর মনোভাব, দুরদর্শিতা ও বিচক্ষণতা স্বল্প সময়ের ব্যবধানে তাঁকে সাফল্যের সুউচ্চ শিখরে পৌঁছে দিতে মূল্যবান ভূমিকা রাখে।
তায়েফে ইসলাম প্রচারে ব্যর্থ হয়ে আল্লাহর রসুল শত্রুপুরী মক্কায় প্রত্যাবর্তন করতে বাধ্য হন। কিন্তু ৬০ মাইল পথ অতিক্রম করার পর মক্কার অদূরে নাখলা নামক স্থানে এসে তিনি তাঁর সঙ্গী জায়েদকে মক্কার অন্যতম শক্তিমান নেতা মোতায়েম ইবনে আদির নিকট সাহায্য ও আশ্রয় প্রার্থনা করার জন্য প্রেরণ করেন। মানবতার খাতিরে তিনি সাহায্য ও আশ্রয় দান করতে সম্মত হন। আল্লাহর রসুল (স:) মক্কায় পৌঁছে মোতায়েমের গৃহে আশ্রয় নেন। মানবতাবাদী মোতায়েম নিজে, তার পুত্রদের এবং স্বগোত্রের লোকদের সঙ্গে হযরত মোহাম্মদ (স:)কে নিয়ে কাবা প্রাঙ্গনে গিয়ে কোরাইশদের উদ্দেশে বলেন, “শোন, আমি মোহাম্মদকে অভয় ও আশ্রয় দিয়েছি। অতএব সাবধান, তোমরা তাকে কিছু বলো না।” এই মোতায়েমই কোরাইশদের প্রতিজ্ঞাপত্র ছিঁড়ে ফেলে শি’বে আবু তালিব গিরি সংকট হতে হযরত মোহাম্মদ (সঃ) ও তাঁর সঙ্গীদের উদ্ধার করার মানবিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
এই পর্যায়ে আল্লাহর রসুল প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার হতে বিরত থাকেন। নবুওয়তের দশম বছর ৬২০ খ্রিষ্টাব্দে রজব মাসে তিনি মক্কার অদূরে আল-আকাবা নামক একটি পার্বত্য উপত্যকায় যান। সেখানে হজ্ব এবং ব্যবসা করতে আসা ইয়াসরিবের খাজরাজ গোত্রের ৬ জন লোকের সঙ্গে তাঁর আলাপ-আলোচনা হয়। তারা ইসলাম কবুল করেন। পরের বছর খাজরাজ গোত্রের দশজন এবং আউস গোত্রের দুইজন- এই বারো জন ইয়াসরিব হতে মক্কায় এসে আকাবায় ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন এবং ইসলামের জন্য আজীবন সংগ্রাম করার শপথ গ্রহণ করেন। যা আকাবার প্রথম শপথ হিসেবে পরিচিত। তারা ইয়াসরিবে ইসলাম প্রচার করার জন্য আল্লাহর রসুলের পক্ষ হতে একজন প্রতিনিধি পাঠানোর আবেদন জানালে তিনি মোসয়াব ইবনে ওমায়েরকে তাদের সঙ্গে পাঠান।
আকাবার প্রথম শপথের পরের বছর হজ্ব উপলক্ষে ইয়াসরিবের বিভিন্ন গোত্রের ৭৩ জন পুরুষ ও ২ জন নারী আকাবার উপত্যকায় এসে পৌঁছান। এই সংবাদে আল্লাহর রসুল উৎসাহিত ও উৎফুল্লবোধ করেন। ১২ জিলহজ্ব তারিখে তিনি চাচা আব্বাসকে সঙ্গে নিয়ে গভীর রাতে আকাবার নির্জন পর্বতের পাদদেশে ইয়াসরিব থেকে আগত নর-নারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং আলাপ-আলোচনার পর তারা সকলে ইসলাম গ্রহণ করেন। আল্লাহর রসুল তাদেরকে প্রাণপণে আল্লাহর পবিত্র কালামকে রক্ষা করার এবং সত্য প্রচারে তাঁকে সাহায্য করার আবেদন জানালে নওমুসলিমগণ একবাক্যে ঘোষণা করেন: “জীবনে-মরণে আমরা আপনার সঙ্গী হয়ে থাকবো। যতই বাধা-বিপদ আসুক না কেন আমরা তা মোকাবেলা করবো। আল্লাহর জন্য, আপনার জন্য, সত্যের জন্য, ইসলামের জন্য আমরা জান-মাল কোরবান করবো। শুধু কোরাইশদের সঙ্গে নয়, দুনিয়ার যে কোন শক্তির সঙ্গে আমরা সত্যের জন্য যুদ্ধ করবো।” এটাই ছিল আকাবার দ্বিতীয় শপথ। হযরত মোহাম্মদ (স:) সকলকে উপদেশ দানের পর প্রতিনিধি দলের মধ্য থেকে ১২ জন লোককে নির্ধারণ করে দিতে বললেন যারা ইসলাম প্রচার করবেন। সঙ্গে সঙ্গে আউস ও খাজরাজ গোত্র হতে ১২ জন লোককে তারা নির্বাচিত করে দিলেন। নওমুসলিমগণ তাদের সঙ্গে আল্লাহর রসুলকে ইয়াসরিব যাওয়ার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করলেন। এই আমন্ত্রণ পাবার পর তিনি বললেন, “মক্কায় যারা ইসলাম কবুল করেছেন তাদেরকে ফেলে আমি আগে ইয়াসরিব যেতে পারি না। প্রথমে তাদের ব্যবস্থা করতে হবে।” ইয়াসরিব থেকে আগত এই প্রতিনিধি দলে ইতিপূর্বে প্রেরিত আল্লাহর রসুলের প্রতিনিধি মুসয়াবও ছিলেন। তিনিও হযরত মোহাম্মদ (সঃ)কে ইয়াসরিবে দ্রুত ইসলামের প্রসার লাভের কথা জানালেন। আল্লাহর রসুলের মন ইয়াসরিব গমনের জন্য উন্মুখ হয়ে রইল।
নবুয়ত লাভের দশম বছরে চরম দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও ইসলামের প্রসার এবং আল্লাহর রসুলের আধ্যাত্মিকতার উচ্চমার্গে উত্তরণ ঘটেছিল। তাঁর বয়স যখন পঞ্চাশ তখন একদিন তিনি মক্কাতে শি’বে আবু তালিবে অবস্থিত আবু তালিবের কন্যা উম্মে হানির বাড়ীতে এশার নামাজ পড়ে নিদ্রিত ছিলেন তখন তাঁর একপাশে নিদ্রিত ছিলেন চাচা হামজা, অন্যপাশে ঘুমাচ্ছিলেন তাঁর চাচাতো ভাই জাফর (রা:)। রাত্রি যখন দ্বিপ্রহর তখন হযরত জিব্রাইল (আ:) তাঁর নাম ধরে ডাক দিলেন এবং তাঁকে বোরাক নামের স্বর্গীয় বাহনে করে প্রথমে জেরুজালেমস্থিত হযরত সুলায়মান (আ:) নির্মিত বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদে নিয়ে যান।
তারপর একে একে জিব্রাইল (আ:) তাঁকে নিয়ে সপ্তম আসমানে সিদরাতুল মুনতাহায় গিয়ে হাজির হন। এরপর আল্লাহর রসুলকে একাকী বায়তুল মামুর পর্যন্ত যেতে হয়। অপূর্ব জ্যোতিস্নিগ্ধ মনোরম এ স্থানে তিনি মহান আল্লাহর স্বরূপ প্রত্যক্ষ করেন। পর্দার আড়াল থেকে উভয়ের মধ্যে সংলাপ হয়। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক করার আদেশপ্রাপ্ত হন তিনি। মেরাজ সম্পর্কে কোরআনের ভাষ্য হচ্ছে: “তাঁরই মহিমা, যিনি তাঁর দাসকে এক রজনীতে পবিত্র মসজিদ (কাবা ঘর) হতে দূরতম মসজিদ (আল-আকসা) পর্যন্ত পরিভ্রমণ করিয়েছিলেন।” (আল-কোরআন, সূরা ১৭, আয়াত-১)
কোরআন মজীদে এ প্রসঙ্গে আরও বলা হয়েছে, “তিনি ক্রমশ আল্লাহর নিকটবর্তী হলেন। দু’টি ধনুকের জ্যার মধ্যে যতটুকু ব্যবধান তিনি তার চেয়েও কম দূরবর্তী ছিলেন। অতঃপর আল্লাহ তাঁর দাস মোহাম্মদ (স:) কে যা প্রত্যাদেশ করার তা করলেন।” (আল কোরআন, সূরা ৫৩, আয়াত ৭-১০)
শর্তসমূহ মুসলমানদের জন্য অসম এবং বিব্রতকর হলেও হুদাইবিয়ার চুক্তি সম্পাদনের পর মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোরাইশদের যুদ্ধংদেহী মনোভাবে ভাটা পড়ে। তাদের কঠোর ও কঠিন প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে। মূর্তি পূজায় উৎসাহ-উদ্দীপনাও হ্রাস পায়। এই সন্ধি, উদীয়মান মুসলিম শক্তির মক্কা বিজয়ে বিরাট ভূমিকা রাখে। তাঁর সাহস, ধৈর্য এবং বিচক্ষণতা তখনকার মানুষকে যেমন মুগ্ধ করে তেমনি অনাগত মানুষদের জন্যও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকে। সৃষ্টি জগতের জন্য তিনি যে রহমতস্বরূপ ছিলেন বিভিন্ন ঘটনায় তা প্রমাণিত হতে থাকে। তাঁর চরিত্রের কমনীয়তা ও দৃঢ়তা, সকল গোঁড়ামী ও হঠকারিতার উপর শেষপর্যন্ত বিজয় অর্জন করতে থাকে।
অত্যাচারী ও নিষ্ঠুর শত্রুর কাছ থেকে সহানুভূতি পাবার আশায় বিনয় ও বশ্যতা অবলম্বনের নীতি নবী করিম (স:)কে কখনো অনুসরণ করতে দেখা যায়নি। তিনি ছিলেন সরল ও অকপট। সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁকে কখনো মিথ্যার আশ্রয় নিতেও দেখা যায়নি। নীতির প্রশ্নে তাকে সব সময় সুদৃঢ় অবস্থান নিতে দেখা গেছে। তবে নীতি বাস্তবায়নে তাঁর কৌশল ছিল অত্যন্ত স্থিতিস্থাপক। তাঁর ব্যক্তিত্ব এবং নেতৃত্ব সহকর্মীদের মুগ্ধ করেছে। তিনি সর্বদা আল্লাহর ওপর নির্ভর করেছেন, সবার জন্য তিনি আল্লাহর ভালোবাসা ও ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। তাঁর দয়া ও মহানুভবতা দেখে বিরোধী পক্ষ পর্যন্ত অভিভূত হয়েছে।
আল্লাহর রসুল হযরত মোহাম্মদ (সঃ)-এর মক্কা বিজয় মানব ইতিহাসের এক চমকপ্রদ অধ্যায়। হোদাইবিয়ার সন্ধির শর্তাবলী একের পর এক কোরাইশগণ লংঘন করতে থাকলে হযরত মোহাম্মদ (স:) ইবনে উম্মে মাকতুমকে মতান্তরে আবুজর গিফারীকে মদীনায় তাঁর প্রতিনিধি নিযুক্ত করে ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে দশ মতান্তরে বারো হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। মক্কার অদূরে ‘মাররাজ’ নামক স্থানে তিনি শিবির স্থাপন করেন। এই সংবাদ পেয়ে কোরাইশদের প্রধান নেতা আবু সুফিয়ান দুইজন সঙ্গী নিয়ে মুসলিম শিবিরে গোপনে ঢুকে পড়ে। হযরত ওমর ফারুক রক্ষীসহ ছদ্মবেশে চারদিক পর্যবেক্ষণ করছিলেন। তাঁর হাতেই আবু সুফিয়ান ও তাঁর দু’জন সঙ্গী বন্দী হন। তাদেরকে আল্লাহর রসুলের কাছে হাজির করা হয়। সকলের ধারণা ছিল যে ইসলামের এই ঘোর দুশমনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। কিন্তু সকলকে অবাক করে দিয়ে আল্লাহর রসুল তাকে ক্ষমা করে দেন। ইসলামের আদর্শ ও হযরত মোহাম্মদ (স:)-এর মহত্ত্বে আবু সুফিয়ান অভিভূত হন। আল্লাহর রসুল তাকে জিজ্ঞেস করেন, “ভুল ভাঙ্গতে আর কতদিন লাগবে?” আবু সুফিয়ান বলেন, “দেব-দেবীর পুজা করি, ভক্তি করি, আজ আমি বন্দী, সাহায্য চেয়ে কোন সাড়া পেলাম না। কি করে আর তাদের সত্য বলি।”
আল্লাহর রসুল বললেন, তবে অকুণ্ঠ চিত্তে বলুন, “আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং মোহাম্মদ এই সত্যের বাহক।” আবু সুফিয়ান বলে উঠলেন: “লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।” আল্লাহর রসুল আবু সুফিয়ানকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। যিনি ছিলেন শত্রু তিনি হলেন মিত্র। মক্কা বিজয়ের ইতিহাস এভাবেই সূচিত হয়। আবু সুফিয়ান মক্কায় ফিরে গিয়ে বললেন, “আমি এখন আর কোরাইশদের নেতা নই। আমি এখন মুসলমান। মোহাম্মদ দশ হাজার সৈন্য নিয়ে আমাদের দ্বারে উপস্থিত। যদি ভাল চাও তো কাবাগৃহে, আমার গৃহে অথবা নিজ নিজ গৃহে অবস্থান করো, তবেই রক্ষা পাবে।
প্রত্যুষে আল্লাহর রসুল মক্কা নগরীতে প্রবেশের আয়োজন করলেন। বিভিন্ন দলপতিকে মক্কার বিভিন্ন রাস্তায় প্রবেশের আদেশ প্রদানকালে এই বলে সতর্ক করে দিলেন যে, “সাবধান, কাউকে আক্রমণ করো না। কেউ আক্রমন করলে আত্মরক্ষা করবে।” প্রথমে মহাবীর খালিদ ঝাণ্ডা উড়িয়ে পাঁচশত সৈন্যের একটি দল নিয়ে কুচকাওয়াজ করে অগ্রসর হলেন। আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হলো। সবার শেষে আল্লাহর রসুল তাঁর ‘কাসওয়া’ নামক উটে আরোহন করে পাঁচ হাজার সৈন্যের একটি বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলেন। কোরাইশদের পক্ষে ইকরামা বিন আবু জহল, মাফওয়া বিন উমাইর প্রমুখ প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিল কিন্তু মহাবীর খালিদ বিন ওয়ালিদের দল তাদের প্রতিরোধ সহজেই চূর্ণ করে দিতে সক্ষম হন। কার্যত বিনা যুদ্ধে, বিনা রক্তপাতে, বিনা ধ্বংসে মক্কা জয় করেন আল্লাহর রসুল। কোরআনের বাণী-নাজিল হয়: “সত্য এসেছে এবং মিথ্যা দূরিভূত হয়েছে, মিথ্যা নিশ্চয়ই প্রত্যাখ্যাত হবে।” [আল কোরআন, সুরা ১৭ আয়াত ৮১]
সমবেত অপরাধীদের উদ্দেশে আল্লাহর রসুল ঘোষণা করলেন, “তোমাদের বিরুদ্ধে আজ আমার কোন অভিযোগ নেই। তোমাদের সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে দিলাম। আল্লাহও তোমাদের ক্ষমা করুণ এবং তোমাদের উপর অনুগ্রহ করুন”। (সুরা ইউসুফ আয়াত ৯২)। যাদের প্রাণদন্ড অবধারিত বলে ধারণা করা হয়েছিল তাদের অপরাধও তিনি ক্ষমা করে দিলেন। ভীত বিহবল একজন লোককে কাঁপতে কাঁপতে আসতে দেখে আল্লাহর রসুল তাকে বললেন, “তুমি কাঁপছো কেন? ভয় পাচ্ছ কেন? আমি তো রাজা বাদশাহ নই- আমি আল্লাহর রসুল।”
৬৩২ খ্রিস্টাব্দে তথা ১০ম হিজরীর ৯ই জিলহজ্ব আল্লাহর রসুল বিদায় হজ্ব উপলক্ষে আরাফাতের ময়দানে এক গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণী ভাষণ দেন। তাঁর সেই ভাষণ নকীবদের মাধ্যমে লক্ষাধিক মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়। পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার মহিমা বর্ণনা এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পর হযরত মুহাম্মদ (স:) বলেন, হে জনমণ্ডলী! অন্ধকার যুগের সমস্ত কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস এবং সকল প্রকার অনাচার পদদলিত, রহিত ও আজ থেকে বাতিল হয়ে গেল। জাহেলী যুগের সমস্ত হত্যা ও খুনের প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার বাতিল করা হল এবং আমি সর্বপ্রথম এ বিষয়ে আমার নিজ গোত্রের রাবী‘আ ইবনে হারিসের পুত্রের খুনের প্রতিশোধ গ্রহণের অধিকার বাতিল ঘোষণা করলাম। জাহেলী যুগের সমস্ত সুদ বাতিল করা হল। আর আমি সর্বপ্রথম আমার চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের সুদ বাতিল করে দিলাম।
হে লোক সকল! তোমরা শুনে রাখো, আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেককেই তার যথাযথ অধিকার দিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং উত্তরাধিকারীর জন্য কোনরূপ ওসীয়াত কার্যকর হবে না।
তিনি একজনের অপরাধের জন্য আরেক জনকে দণ্ড দানের বিধান রহিত করে দিয়ে বলেন, অতঃপর পিতার অপরাধের জন্য পুত্র এবং পুত্রের অপরাধের জন্য পিতাকে দায়ী করা চলবে না। কোন কাফ্রি ক্রীতদাসকেও যদি তোমাদের আমীর করে দেয়া হয় এবং সে যদি আল্লাহর বিধান মোতাবেক তোমাদেরকে পরিচালনা করেন তবে তোমরা তাঁর আনুগত্য করবে এবং তার আদেশ মেনে চলবে। সাবধান! ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না, এই বাড়াবাড়ি করার কারণে তোমাদের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। স্মরণ রেখো, তোমাদের সকলকেই আল্লাহর সামনে হাজির হতে হবে। তাঁর কাছে সকল ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে। সাবধান! আমার পর তোমরা পথভ্রষ্ট হয়ো না, আত্মঘাতি রক্তপাতে লিপ্ত হয়ো না। আজকের এই হজ্বের দিন যেমন মহান, এই মাস যেমন মহিমামন্ডিত, মক্কার এই মসজিদুল হারাম যেমন পবিত্র, প্রতিটি মুসলমানের ধন-সম্পদ, মান-সম্ভ্রম, রক্ত এবং জীবন তেমনি পুতঃপবিত্র। এই পবিত্রতার হানিকারী মহাপাতক হিসেবে গণ্য হবে।
হে মানবমণ্ডলী! নিশ্চয়ই তোমাদের রব এক, তোমাদের আদি পিতা হযরত আদম (আ:) এক। সাবধান! অনারবের উপর আরবের, কিংবা আরবের উপর অনারবের, কালো বর্ণের মানুষের উপর সাদা বা লাল বর্ণের, কিংবা সাদা বা লাল বর্ণের মানুষের উপর কালো বর্ণের মানুষের কোনও শ্রেষ্ঠত্ব নেই। আর প্রত্যেক মুসলমান একে অন্যের ভাই এবং সকলে মিলে এক অবিচ্ছেদ্য ভ্রাতৃসমাজ। তোমাদের দাস-দাসীদের ব্যাপারে সাবধান! তোমরা যা খাবে তাদেরকে তাই খেতে দিও, তোমরা যা পরিধান করবে তাদেরকেও তাই পরিধান করতে দিও। এতে কোন রকম তারতম্য করো না।
হে বিশ্বাসীগণ! র্শিক করো না, অন্যায়ভাবে নরহত্যা করো না, পরস্ব অপহরণ করো না, ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়ো না। হে লোক সকল! শ্রবণ কর, গ্রহণ কর এবং নবজীবন লাভ করো। সাবধান! কোন মানুষের ওপর অত্যাচার করো না। সাবধান! কারও সম্মতি ছাড়া সামান্য ধনও গ্রহণ করো না। হে লোক সকল! নারীদের সম্পর্কে আমি তোমাদর সতর্ক করে দিচ্ছি যে, তাদের প্রতি নিষ্ঠুর ব্যবহার করো না, আল্লাহর দণ্ডের ভয় করো। আল্লাহর কালামের ভিত্তিতেই তাদের সঙ্গে তোমাদের দাম্পত্য স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সহধর্মিনীগণের ওপর তোমাদের যেমন দাবি ও স্বত্বাধিকার আছে, তোমাদের ওপরও তাদের তেমনি দাবি ও স্বত্ত্বাধিকার রয়েছে।
হে আমার উম্মতগণ! শয়তান নিরাশ হয়েছে, এ শহরে আর শয়তানের উপাসনা হবে না। তবে নিজেদের কর্তব্য কর্মকে তুচ্ছ জ্ঞান করলে তাতেই শয়তান সান্ত¡না পাবে এবং খুশি হবে।
আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর বাণী রেখে যাচ্ছি যা তোমরা দৃঢ়ভাবে ধরে রাখলে কখনও পথভ্রষ্ট হবে না। মনে রেখো, আমার পর আর কোন নবী আসবে না, তোমাদের পর আর কোন উম্মতও থাকবে না। হে বিশ্বাসীগণ! সালাত কায়েম রেখো এবং যাকাত দিও। রমজান মাসে রোজা রেখো। হজ্ব আদায় করো। বৈধ শাসকের অনুগত থেকো। বংশের গৌরব করো না। যে ব্যক্তি নিজ বংশকে হেয় মনে করে এবং অপর কোন বংশের নামে আত্মপরিচয় দেয় তার ওপর নেমে আসে আল্লাহর অভিশাপ। তোমাদের মধ্যে যে উত্তম কাজ করবে সেই শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হবে।
আজ যারা উপস্থিত রয়েছো তারা অনুপস্থিতদের কাছে আমার বক্তব্য পৌঁছে দিও। উপস্থিত অনেকের চেয়ে অনুপস্থিত অনেকে আমার এই বক্তব্যকে অধিক গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করতে পারে।
হযরতের মুখমন্ডল ধীরে ধীরে স্বর্গীয় প্রভায় দীপ্ত এবং তার কণ্ঠ সত্যের তেজে বলিষ্ঠ হয়ে উঠলো এবং তিনি আকাশ পানে তাকিয়ে পরওয়ারদিগারের উদ্দেশে বললেন, হে আল্লাহ! আমি কি তোমার বাণী পৌঁছে দিয়েছি, আমি কি আমার কর্তব্য সম্পাদন করেছি? লাখো কণ্ঠে জবাব এলো, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। আল্লাহর রসুল বললেন, হে আমার রব, শোন এবং সাক্ষী থাকো।
এরপরই তাঁর ওপর নাজেল হয় সমাপ্তি সূচক প্রত্যাদেশ: “আজ ইসলাম পূর্ণাঙ্গরূপ লাভ করলো, তোমাদের ওপর আমার নেয়ামত সমাপ্ত হলো। ইসলামকে তোমাদের জীবন বিধান করা হলো। (সূরা ‘আল মায়েদা, আয়াত-৩)। শিয়া ঐতিহ্যের অনুসারীগণ বিশ্বাস করেন হজ্বের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে মদীনা প্রত্যাবর্তন কালে খোম জলাশয়ের কাছে পৌঁছালে আলোচ্য প্রত্যাদেশ অবতীর্ণ হয়েছিল। কোন তথ্য সঠিক তা আল্লাহই ভাল জানেন।
বিদায় হজ্ব থেকে প্রত্যাবর্তন করার পর হযরত মোহাম্মদ (স:) তিন মাস বেঁচেছিলেন। ৬৩ বছর বয়সে তিনি তাঁর স্বজন ও অনুসারীদের শোক সাগরে ভাসিয়ে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ৮ জুন, ১১ হিজরীর ১২ রবিউল আওয়াল সোমবার নিজ গৃহে ইন্তেকাল করেন (ইন্নাহিল্লাহে অইন্না ইলাইহে রাজেউন)। তাঁর ইন্তেকালের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে আরবের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য প্রাণাধিক প্রিয় এই মানুষটির লাশের কাছে এসে ভিড় করেন এবং সুশৃঙ্খলভাবে শ্রদ্ধা জানিয়ে অশ্রুসজলনেত্রে বিদায় নিতে থাকেন। ফলে বিলম্বিত হতে থাকে তাঁর লাশ সমাহিত করার কাজ। মঙ্গলবার মতান্তরে বুধবার যেখানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন সেখানেই তাঁর স্বজনেরা যথাযোগ্য মর্যাদায় তাঁর লাশ সমাহিত করেন।
ইহুদী-খ্রিস্টান ঐতিহ্যের ধারায় হযরত মোহাম্মদ (স:) শেষ নবী হিসেবে একেশ্বরবাদ প্রচারে অতুলনীয় সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। পৃথিবীতে যত ধর্ম আছে তার মধ্যে ইসলামই সবচে সুসংবদ্ধ ধর্ম। এ ধর্মে জোর-জবরদস্তির কোন স্থান নেই। নেই বৈরাগ্য ও সন্ত্রাসের কোন সুযোগ।